বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভেজাল গুড়ে মাথায় হাত ব্যবসায়ীর

  •    
  • ২৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ১১:২৫

ক্ষুদ্র গুড় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভেজাল গুড় তৈরির জন্য এক শ্রেণির বড় মহল গড়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে খেজুরের ঝোলা গুড় কিনে এনে তার সঙ্গে রং, আটা ও চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে। চিনির দাম কম হওয়ায় তারা এ সুযোগ নিচ্ছে। ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে এসব গুড় কিনে এনে সরবরাহ করছে। আসল গুড়ের অর্ধেক দামে ভেজাল গুড় বিক্রি হচ্ছে।

ফরিদপুর জেলার গ্রাম-গঞ্জে এক সময় রাস্তার দুই ধারে, নদ-নদীর পাড়ে ও বসতবাড়ির আঙিনায় সারি সারি খেজুর গাছের দেখা মিলত। শীতের আগমনের আগে হেমন্তের মাঝামাঝিতেই এসব গাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছ কাটতে কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন গাছিরা। পিঠে বাঁশের চটা দিয়ে বানানো খোল, তার মধ্যে গাছ কাটার ধারালো হাসুয়া, তালের খোলা আর পোড়া বালি। কোমরে দড়ির গোছা। কাঁধে বাঁশের মোটা চটার দুই ধারে থাকত রসে ভরা হাড়ি।

শীত এলে ফরিদপুরের গ্রাম-গঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছিল এ এক চিরচেনা দৃশ্য। তবে এই দৃশ্য এখন আগের মত দেখা যায় না। জেলায় আগের চেয়ে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, এই পেশায় গাছিদের আগ্রহ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমেছে গুড়ের। আর এই সুযোগে হাটবাজার সয়লাব হয়ে গেছে ভেজাল গুড়ে। খাঁটি গুড়ের প্রায় অর্ধেক দামে মিলছে চিনি ও রং মিশ্রিত এসব ভেজাল গুড়।

ফরিদপুর সদরের গঙ্গাবর্দী এলাকার কৃষি ইনস্টিটিউট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। রস চুলায় দিয়ে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করতে প্রায় দেড় ধেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে।

রস জ্বালিয়ে তৈরি করা গুড়ের চাহিদা অনেক। এ সময় চার থেকে পাঁচ জন ক্রেতাকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

জ্বাল দেয়ার জন্য রস ছাঁকা হচ্ছে। ছবি: নিউজবাংলা

খেজুরের গুড় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কৃষি কলেজ এলাকার বাসিন্দা এনামুল হাসান গিয়াস। তিনি বলেন, আগের চেয়ে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে গেছে। তাছাড়া গাছ কেটে রস বের করার জন্য গাছিও পাওয়া যায় না। রাজশাহী, যশোরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে গাছিদের আনতে হয়।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ফরিদপুরে প্রায় ২শ হেক্টর জমির উপর প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। এসব গাছ থেকে প্রায় ১৫শ ৫০ টন রস হয়। যা থেকে পাওয়া যায় প্রায় আড়াইশ টন গুড়। জেলায় সবচেয়ে বেশি খেজুর গাছ রয়েছে বোয়ালমারী ও নগরকান্দা উপজেলায়, প্রায় ৩০ হাজারের মতো। এরপরে রয়েছে ভাঙ্গায় প্রায় ১৪ হাজারের মতো।

এনামুল জানান, তিনি প্রতি কেজি খেজুর খাঁটি গুড় সর্বনিম্ন দর চারশ টাকায় বিক্রি করছেন এবছর। অবশ্য বিভিন্ন স্থানে গুড় ৫শ থেকে ৬শ টাকা দরে বিক্রি হয় বলেও জানা গেছে। আর চিনি ও রং মিশ্রিত ভেজাল গুড় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে দেড়শ থেকে তিনশ টাকা করে।

তিনি আরও জানান, গুড় ছাড়াও খেজুর গাছের পাতা মাদুর ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে যে হারে খেজুর গাছ কাটা পড়ছে সে অনুপাতে লাগানো হচ্ছে না। ফলে সম্প্রতি খেজুর গাছের সংখ্যা ব্যাপক হারে কমেছে।

রঘুয়ারকান্দী গ্রামের গাছি তৈয়ব মিয়া জানান, গ্রামে খেজুর গাছ নেই বলে এখন আর রসের জন্য গাছ কাটেন না। আগে তিনি একাই প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি গাছ কাটতেন। তখন বাজারে গুড়ের দামও ছিল কম। এখন গরিব মানুষের পক্ষে খেজুরের গুড় কিনে খাওয়া সম্ভব না।

তবে বিপরীতমুখী বক্তব্য যদুনন্দী গ্রামের গাছি জয়নাল শেখের। তিনি জানান, তিনি এখনও প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি খেজুর গাছ ঝুড়েন এবং এই রস জ্বালিয়ে ৩০ কেজির মতো গুড় হয়।

তিনি বলেন, তবে কিছু লোক আমাদের থেকে গুড় কিনে নিয়ে তাতে চিনি ও রং মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে বলে শুনেছি।

রস সংগ্রহের জন্য গাছ কাটছেন এক গাছি। ছবি: নিউজবাংলা

রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার দিঘা গ্রামের বাসিন্দা গাছি মো. লালন আলী প্রামাণিক নভেম্বর মাসের শুরুতে এসেছেন ফরিদপুরে। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আরও তিন সহযোগীকে। লালন প্রামাণিক বলেন, কৃষি কলেজ ও আশপাশের ১৫০টি খেজুর গাছ আমরা তিনজন দেখভাল করছি। নভেম্বর মাসের শুরুতে এসেছি। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে বাড়িতে যাব।

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি গাছ আমরা ৩শ টাকা করে এ বছরের জন্য লিজ নিয়েছি। গাছ কাটার প্রথম এক মাস রস বের হয় না। পরের দুই মাস রস পাওয়া যায়। এখন মোটামুটি রস পাচ্ছি আমরা। রস বিক্রি করছি ৪০ টাকা লিটার। এছাড়া এক হাড়ি (৮ লিটার) নিচ্ছি ৩৫০টাকা। আর ঝোলা গুড় বিক্রি করছি ৩শ টাকা, শক্ত পাটালি বিক্রি করছি ৪শ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি।

রাজশাহী থেকে আসা গাছি সেলিম মণ্ডল বলেন, বাদুর যাতে রসের হাড়ির উপর বসতে বা মুখ দিতে না পারে সেজন্য নীল কাপড় দিয়ে হাড়ির মুখ বেঁধে দেয়া হয়। নিপা ভাইরাস প্রতিরোধে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিদিন ১৫০টি গাছের মধ্যে ৮০টি গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। তাতে প্রতিদিন ২৫০ লিটার রস সংগ্রহ করতে পারি। এই রসে প্রতিদিন ১৫ কেজি গুড় তৈরি হয়। তবে যে গুড় তৈরি হয়, তাতে চাহিদা পূরণ হয় না। অনেককেই গুড় দিতে পারি না।

ক্ষুদ্র গুড় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ভেজাল গুড় তৈরির জন্য এক শ্রেণির বড় মহল গড়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে খেজুরের ঝোলা গুড় কিনে এনে তার সঙ্গে রং, আটা ও চিনি মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরি করে। চিনির দাম কম হওয়ায় তারা এ সুযোগ নিচ্ছে। ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে এসব গুড় কিনে এনে সরবরাহ করছে।

তারা জানান, আসল গুড়ের অর্ধেক দামে ভেজাল গুড় বিক্রি হচ্ছে।

জ্বাল দেয়ার পর তরল খেজুর গুঁড় রাখা হচ্ছে পাত্রে। ছবি: নিউজবাংলা

ফরিদপুর জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সোহেল শেখ বলেন, এ ব্যাপারে তাদের নজরদারি রয়েছে। তবে বাজারে যারা গুড় বিক্রি করে তারা স্বীকার করে যে চিনি দিয়েই তারা গুড় বানান। ভেজাল গুড় তৈরির উৎসের কোনো সন্ধান থাকলে তিনি তথ্য দিয়ে সহায়তার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, বেশ কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানাও করা হয়েছে।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, বিলুপ্তির হাত থেকে খেজুর গাছ রক্ষা করতে গ্রামের রাস্তার দুই পাশে ও অব্যবহৃত পতিত জমিতে খেজুর গাছ রোপণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রণোদনার মাধ্যমে গাছিদের জীবনমান উন্নত করতে পারলে এ পেশার প্রতি তাদের আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ জিয়াউল হক বলেন, ইট ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ থাকায় সম্প্রতি খেজুর গাছ কাটা কমেছে। তাই এবার জেলায় আগের বারের চেয়ে বেশি রস ও গুড় পাওয়া যাবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গাছিরা যাতে খেজুর গাছ কেটে রসের সদ্ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এতে ফরিদপুরের খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য আবারও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আমি আশাবাদী।

এ বিভাগের আরো খবর