সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান ও লকপুর গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে ৩৩৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ের মামলা করেছে জনতা ব্যাংক।
শতাধিক কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি ও ৪০ কোটি টাকা জরিমানা দাবি করে বন্ড লাইসেন্স বাতিলের পর এই মামলা করা হলো।
ব্যাংকে জালিয়াতি করে ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলাও আছে গোপনে বিদেশে চলে যাওয়া আমজাদ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।
খুলনার অর্থ ঋণ আদালতে গত ৩০ নভেম্বর জনতা ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখা থেকে মামলা তিনটি করা হয়। এতে আমজাদ ছাড়াও তার স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ এবং লকপুর গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে আসামি করা হয়েছে।
মামলা তিনটি আদালত নথিভুক্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে আগামী মার্চে আসামিদের বিষয়ে আদেশ দেয়ার কথা জানিয়েছেন বিচারক।
ইস্টার্ন পলিমারের খেলাপি ঋণ ১৫১ কোটি
মোংলা ইপিজেডে অবস্থিত এই কোম্পানিটি শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে জনতা ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের মাধ্যমে চলত আমদানি ও রপ্তানি।
গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত কোম্পানিটির খেলাপি ঋণ ১৫১ কোটি ৮৪ লাখ ৫ হাজার ৬১৬ টাকা। বিদেশি পণ্য আমদানির জন্য এলসি মার্জিন ঋণসহ বিভিন্ন প্রকার ঋণ পরিশোধ না করায় এ মামলা করা হয়।
আসামিরা হলেন এমডি এস এম আমজাদ হোসেন এবং পরিচালক তার স্ত্রী বেগম সুফিয়া আমজাদ।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি এবং ৭ এপ্রিল টাকা পরিশোধের তাগাদাপত্র দেয়া হয় আসামিদের। তারা সাড়া না দেয়ায় ব্যাংকের আইনজীবী ২০২২ সালের ১ অক্টোবর আইনি নোটিশ পাঠান।
এরপর ঋণ আদায়ে সম্পত্তি ও কারখানা নিলামের জন্য ২০ অক্টোবর একটি জাতীয় ও একটি স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু কোনো বিডার নিলামে অংশ না নেয়ায় জমি ও কারখানা বিক্রি করা সম্ভব হয়নি।
এই ১৫১ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে খুলনার রুপসার জাবুসা মৌজায় ৯ একর জলাভূমি বন্ধন দেখানো আছে। খুলনা সাব রেজিস্ট্রার দপ্তরে এই জলাভূমির দর দেখানো হয়েছে একর ৭৫ হাজার টাকা করে। এই হিসাবে ৯ একরের দাম আসে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
মুনস্টার পলিমারে খেলাপি ৯০ কোটি
মোংলা ইপিজেড অবস্থিত এই কোম্পানিটিও রপ্তানিমুখি। ২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের দিলখুশা শাখা থেকে তারা প্রথম ঋণ নেয়, পরে তা স্থানান্তর করা হয় খুলনা করপোরেট শাখায়।
গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৯০ কোটি ৮১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩৩ টাকা।
এই মামলাতেও আসামি আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ।
মামলায় বলা হয়, ব্যাংক টাকা আদায়ের গত ৬ জুন চূড়ান্ত তাগাদাপত্র এবং ১ অক্টোবর আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। তবে কোনো সাড়া মেলেনি।
এরপর বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রিতে ২০ অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জাতীয় এবং স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সে নিলামেও কেউ অংশ নেয়নি।
বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনালের খেলাপি ঋণ ৯৫ কোটি টাকা
বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট থানার নওয়াপাড়ার শ্যামবাগায় এই কারখানাটিও আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। ২০১৪ সাল থেকে তাদের লেনদেন জনতা ব্যাংকের সঙ্গে।
২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের কাছে খেলাপি ঋণ ৯৫ কোটি ৪৭ লাখ ২৯ হাজার ৭৫৩ টাকা।
এই মামলার আসামি হিসেবে আমজাদ হোসেন ও তার স্ত্রী ছাড়াও নাম আছে তাদের মালিকানাধীন বাগেরহাট সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড, মেট্রো ব্রিক্স লিমিটেড, রুপসা ফিস অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও সাউদার্ন ফুডস লিমিটেডকেও।
২০২২ সালের ৬ জুন চূড়ান্ত পত্র এবং ১ অক্টোবর আইনি নোটিশ দেয়া হয়। এরপর ২০ সেপ্টেম্বর নিলামের দিন ঠিক করে দুটি পত্রিকায় দেয়া হয় নিলাম বিজ্ঞপ্তি। কিন্তু তাতে কেউ অংশ নেয়নি।
অস্বাভাবিক ঋণে তদন্ত কমিটি
৩৩৮ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে খুলনার রূপসায় ৮ দশমিক ১৪ একর, বটিয়াঘাটা থানার জিরোপয়েন্ট ৯ দশমিক ২৮ একর জলাভূমি এবং বাগেরহাটের ফকিরহাটে ৩ দশমিক ৩৩ একর জমি বন্ধক দেয়া হয়েছে।
স্থানীয় ভূমি অফিস এবং সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সরকারি দর অনুযায়ী এসব জমির দাম ৫০ কোটি টাকার বেশি হবে না।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে দেয়া মঞ্জুরির অতিরিক্ত ঋণ দেয়ার ঘটনায় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এই কমিটি ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর জনতা ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখার ডিজিএমকে ১১টি বিষয়ে অভিযুক্ত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে।
সে সময় ডিজিএম অরুণ প্রকাশ বিশ্বাস জবাব দেন, ‘এই জমি ছাড়া ফ্যাক্টরি যন্ত্রাংশ, উৎপাদিত পণ্যের প্লেজের ঋণ এবং এলসি মার্জিন ঋণসহ নানাবিধ ঋণ রয়েছে। এছাড়া জমির মূল্য আগামীতে বৃদ্ধি পেতে পারে।’
আরও অনিয়ম
লকপুরের বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। চারটি প্রতিষ্ঠানের ১০৪ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দাবি করে আরও ৪০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড করে বন্ড লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
আমজাদ হোসেনের সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
এজাহারে বলা হয়, ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া ঋণ সৃষ্টি করে ২০ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন আমজাদ হোসেনসহ অভিযুক্তরা। পরে ওই অর্থ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়।
দুদকের মামলার পরে নভেম্বর মাসে গোপনে বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান আমজাদ হোসেন। সঙ্গে যান স্ত্রী সুফিয়া আমজাদও।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে লকপুর গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (বর্তমান পরিচালকের দায়িত্বে) খান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মামলা বা ঋণ খেলাপির বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’