বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মৃত্যু ও তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তার সহপাঠীরা। তার ‘আত্মহত্যা’ প্রশ্নে ডিবি ও র্যাবের কাছে জবাব খুঁজেছেন শিক্ষার্থীরা। অবশেষে ‘সন্তোষজনক’ জবাব পেয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে পিছু হটেছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
শনিবার সন্ধ্যায় বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট শিক্ষার্থীরা জানান, আপাতত তারা প্রতিবাদ কর্মসূচি দিচ্ছেন না। ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়ে র্যাব ও ডিবি যেসব তথ্য-প্রমাণ দেখিয়েছে তাতে আর ‘প্রশ্ন করার সুযোগ নেই’ বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) যেসব তথ্যপ্রমাণ তাদের সামনে তুলে ধরেছে, সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানান বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট শিক্ষার্থীরা ফারদিনের মৃত্যু নিয়ে তাদের প্রশ্নের কথা জানান। ছবি: নিউজবাংলা
বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, ডিবি ও র্যাবের দেয়া তথ্য ও প্রমাণ নিয়ে আমরা পাঁচটা প্রশ্ন করেছি। এসব প্রশ্নের মোটামুটি সন্তোষজনক উত্তর আমরা পেয়েছি। আমাদের কাছে সেগুলো প্রাসঙ্গিক ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তারা যে তদন্ত করছে তা সন্তোষজনক। এখন আর সন্দেহ করার মতো তথ্য ও প্রশ্ন আমাদের কাছে নেই।
গত ৪ নভেম্বর বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এ বিষয়ে হত্যা মামলা হলে তা তদন্ত করছে ডিবি। পাশাপাশি র্যাবসহ আরও কয়েকটি সংস্থা ছায়াতদন্ত করছে।
তদন্তের শুরু থেকে বিষয়টিকে হত্যা বলে ধরে নেয়া হলেও গত বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকে বলা হয়, হত্যা নয়, ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন। ডিবির এ দাবি নাকচ করে বুয়েট শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।
ডিবি ও র্যাব অফিস থেকে কিছু তথ্যপ্রমাণ যাচাইয়ের পর শনিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হয়ে চারজন কথা বলেন। তবে কেউই তাদের নাম-পরিচয় বলেননি।
শিক্ষার্থীরা বলেন, তদন্ত নিয়ে ডিবি আমাদের যেসব তথ্য-উপাত্ত দেখিয়েছে সে বিষয়ে আমরা পাঁচটি প্রশ্ন করেছি।
আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ফারদিনের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন আছে বলে জানিয়েছিলেন চিকিৎসক। সেক্ষেত্রে এটি হত্যা না হয়ে আত্মহত্যার দিকে কীভাবে গেল?
জবাবে কর্মকর্তারা জানান, ময়নাতদন্তের সময় প্রাথমিকভাবে ডাক্তার শরীরে আঘাতের বিষয়ে কথা বলেন। পরে ডিবির সঙ্গে চিকিৎসকের কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আঘাতের ধরনটা ছিল মাথার উপর অনেকটা কিল-ঘুষির মতো। এখানে কোনো কাটা চিহ্ন ছিল না। আঘাত ছিল রক্ত জমাট বাঁধার মতো। ভিকটিমের জামাকাপড় ছেঁড়া ছিল না, জামার সব বোতাম অক্ষত ছিল।
কেউ যদি সেতুর উপর থেকে নদীতে লাফ দেয় তাহলেও স্রোতের বা স্প্যানে আঘাতে বা পানিতে লাফ দেয়ার সময় অন্য আঘাতের কারণে এ ধরনের চিহ্ন হতে পারে। সুতরাং এই আঘাতের কারণে শতভাগ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় যে এটা আত্মহত্যা না।
শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল- ডিবির জব্দ করা সিসিটিভি ফুটেজে যাকে সেতু থেকে লাফ দিতে দেখা গেছে, তিনিই ফারদিন কিনা?
জবাবে ডিবি বলেছে, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে ফারদিন যাত্রাবাড়ী থেকে একটা লেগুনায় উঠেছেন। লেগুনাটি তাকে সুলতানা কামাল ব্রিজের অপর পাড়ে নামিয়ে দেয়। লেগুনা ড্রাইভারের মোবাইল লোকেশন এবং ফারদিনের মোবাইল লোকেশন ক্রস চেক করে এটি কনফার্ম করা হয়েছে।
ফারদিনের মোবাইল লোকেশন এবং ব্রাউজিং ডেটা যাচাই করা হয়েছে। সে অনুসারে রাত ২টার পর ফারদিন বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঢুকেছেন। তারাবো ব্রিজ থেকে ফারদিন সুলতানা কামাল ব্রিজের মাঝামাঝি অংশে চলে যান। যে স্থান থেকে ঝাপ দেয়ার ফুটেজ পাওয়া গেছে, সেখানেই তার সবশেষ মোবাইল লোকেশন শনাক্ত হয়েছে।
একই মোমেন্টে অন্য আরেকজনের সেতু থেকে লাফ দেয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। ঝাঁপ দেয়ার পরপরই তার মোবাইল অফ হয়ে যায়। এর ২০ মিনিট পর ফারদিনের হাতঘড়িও অফ হয়ে যায় বলে প্রমাণ মিলেছে। এসবের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, যে ব্যক্তি সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন তিনিই ফারদিন।
তদন্তকারীদের কাছে শিক্ষার্থীদের তৃতীয় প্রশ্ন ছিল- ফারদিন সেদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন, তার সলিড প্রমাণ কী আছে?
জবাবে ডিবির দাবি, সেদিন ছাড়াও ফারদিনের আগের গতিবিধি ও যোগাযোগ যাচাই করা হয়েছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। সেদিন রাত ১০টা ৪৫ মিনিট থেকে ১১টা ৯ মিনিট পর্যন্ত ফারদিন বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। তাদের কথোপকথন স্বাভাবিক ছিল। ওই সময় ফারদিনের অবস্থান ছিল জনসন রোডে। তিনি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সময়ও ফোনে কথা বলেছেন। তার কথার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না বলে অন্যরা জানিয়েছেন।
রাত ১টা ৫৭ মিনিট থেকে পরবর্তী দুই মিনিট মেসেঞ্জারে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন ফারদিন। সেই বন্ধুর চ্যাট যাচাই করা হয়েছে। সেখানেও অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি।
ফারদিনের অস্বাভাবিক ঘোরাঘুরি দেখে র্যাবের সন্দেহ ছিল, তিনি কারও কব্জায় আছেন। কিন্তু পরে মোবাইল ডেটা ও সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিনি স্বাধীনভাবেই ঘোরাঘুরি করেছেন।
ফারদিনের রাত ২টা ২৫ মিনিট থেকে পরবর্তী দশ মিনিটের ব্রাউজিং হিস্ট্রি শিক্ষার্থীদের দেখায় র্যাব। তিনি ফেসবুক, টুইটারসহ কয়েকটি ওয়েবসাইট ব্রাউজ করেন। শেষের দুই মিনিট তিনি ইউটিউবে একটি ক্লাসিক্যাল ইন্ডিয়ান গান শোনেন। এর ৩৫ সেকেন্ড পরই তাকে ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে দেখা যায়। তিনি জিম্মি থাকলে সেই মূহুর্তে ফেসবুক ব্রাউজিং বা গান শোনার কথা না।
শিক্ষার্থীদের চতুর্থ প্রশ্ন ছিল লেগুনা ড্রাইভারের তথ্য নিয়ে। সেতুতে নামা ব্যক্তিই ফারদিন, সেটি চালক কীভাবে নিশ্চিত হলেন?
উত্তরে ডিবি জানায়, লেগুনা ড্রাইভারকে আটকের আগে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছিল। তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক আচরণ পাওয়া যায়নি। ঘটনার দিন ঠিক কতোজন যাত্রী নিয়ে তিনি যাত্রা করেছিলেন, আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সঠিকভাবে তা বলতে পারেননি। কারণ, ঘটনা অনেকদিন আগের।
চালকের বক্তব্য অনুসারে, রাতে তিনি ৫/৬ জন যাত্রী নিয়ে যাত্রা করেছিলেন। তারাবো ব্রিজের পাড়ে ও বাজারের কাছে দুই জনকে নামিয়ে দেন। সেই দুই জনের একজন ফারদিন বলে ধরে নেয়া যায়। কারণ সময় ও ফারদিনের মোবাইলের অবস্থান সে দিকেই ইঙ্গিত করে।
শিক্ষার্থীদের পঞ্চম প্রশ্ন ছিল মাদক, চনপাড়া বস্তি, গাড়ির ফুটেজসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। এসব সংবাদ ও তথ্যের ভিত্তি জানতে চান শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, ‘আমরা মূলত ডিবির কাছে পঞ্চম পয়েন্ট নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ পাইনি। এই বিষয়গুলো নিয়ে ডিবি থেকে আগে কিছু বলা হয়নি। র্যাবের কাছে যাওয়ার পর এইগুলো নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ হয়।’
পঞ্চম প্রশ্নের জবাবে র্যাব জানায়, তারা তদন্ত শুরু করেছিল তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে- পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু অথবা আত্মহত্যা। সব দিক থেকে তথ্যপ্রমাণ যাচাই করা হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তারা বলেন, তদন্ত শুরু করার পর ফারদিনের রবি সিমের নম্বরটি ট্র্যাক করে এমন একটি লোকেশন পাওয়া যায় যেটির বেশিরভাগ এলাকা মূলত চনপাড়ার। সুলতানা কামাল ব্রিজের অংশবিশেষও এটিতে কাভার করে। যেহেতু চনপাড়ার অংশ বেশি তাই র্যাব চনপাড়া এলাকা টার্গেট করে। ওই সময় আটক চনপাড়ার কয়েকজন সন্ত্রাসী দাবি করে, তারা ফারদিনকে হত্যা করেছে। র্যাব ক্রস চেক এবং তদন্ত করে এ বিষয়ে কিছু না পেলে সুলতানা কামাল ব্রিজ সংলগ্ন এলাকার দিকে ফোকাস করা হয়।
গাড়ির ফুটেজ বিষয়ে র্যাব শিক্ষার্থীদের জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সন্ত্রাসীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ফুটেজ দেখেছে র্যাব। আগে এ বিষয়ে তথ্য ছিল না। আর সিএনজি অটোরিকশার একটি ফুটেজ গণমাধ্যমে এসেছে, সেটি সঠিক ছিল না।
সেই ফুটেজে যাকে ফারদিন বলে দাবি করা হয়েছে তাকে গেঞ্জি পরা অবস্থায় দেখা গেছে। কিন্তু মরদেহ উদ্ধারের সময় ফারদিনের পরনে শার্ট পাওয়া গেছে। ফারদিনের বাবা ফুটেজ দেখে র্যাব আর ডিবিকে আশ্বস্ত করেছেন সেটি ফারদিন নন। ফারদিনের মোবাইল লোকেশনের সঙ্গে সেই অটোরিকশার লোকেশন ম্যাচ করেনি।
চনপাড়ার একটি পক্ষ দাবি করেছিল, রাত ১১টায় চনপাড়া বস্তিতে একজনকে হত্যা করা হয়েছে, আর এটাই ফারদিন। র্যাব তদন্ত করে দেখতে পায়, সেই খুনটা হয়েছে রাত ১১টা নাগাদ। সে সময় ফারদিন রামপুরা থেকে জনসন রোড এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন। দূরত্ব বিবেচনায় তার চনপাড়া যাওয়া সম্ভব ছিল না।
র্যাব এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ধরে যে তদন্ত করেছে, সেখানে গত এক বছরে ফারদিনের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ হয়েছে তাদের সবার তথ্য যাচাই করা হয়েছে। সেখানে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি।
ফারদিনের আত্মহত্যা ইস্যুতে ৫ প্রশ্নের জবাব পেয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, আপাতত ফারদিনের মৃত্যুর বিষয় নিয়ে আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। ফারদিনের পরিবার যদি যৌক্তিক দাবিতে কিছু করে,আমরা তাদের পাশে দাঁড়াব। তবে আমাদের কাছে এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন করার মতো এলিমেন্ট নেই।