হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ সংগঠনটির আটক সব নেতা-কর্মীর মুক্তি দাবি করা হয়েছে। শনিবার ধর্মভিত্তিক সংগঠনটির জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন থেকে এই দাবি জানানো হয়েছে।
রাজধানীর গুলিস্তানে কাজী বশীর মিলনায়তনে হেফাজতে ইসলামের জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় শনিবার। হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফী ঘোষিত সংগঠনটির ১৩ দফা বাস্তবায়ন, নেতা-কর্মীদের নামে দায়ের হওয়া সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, কারাবন্দি হেফাজতের সব নেতা-কর্মীর দ্রুত মুক্তির দাবি ও জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সম্মেলনে বন্দি নেতাদের মুক্তি ছাড়াও শিক্ষা কমিশনে আলেমদের প্রতিনিধি রাখার দাবি জানান বক্তারা। সম্মেলন থেকে সরকারের কাছে সাতটি দাবি তুলে ধরা হয়।
হেফাজতে ইসলামের নেতা ও মামুনুল হকের ভাই মাহফুজুল হক বলেন, ‘কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য আমাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষাকে সংকুচিত করা যাবে না। আগামীতে এ ধরনের অপপ্রয়াস চালানো হলে তা প্রতিহত করা হবে।’
হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মহিউদ্দিন রাব্বানী বলেন, ‘আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মামুনুল হক, সাখাওয়াত হোসেন রাজীসহ যেসব নেতা কারাগারে রয়েছেন তাদের এই বছরের মধ্যে মুক্তি দিতে হবে।’
সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে হেফাজতের আমীর শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, ‘শাহ আহমদ শফী ঘোষিত হেফাজতের ১৩ দফা আন্দোলনে ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। একজন মুমিনের কাছে তার জানের চেয়েও ঈমান প্রিয়।
‘অতএব দেশের প্রতিটি মুসলমানই হেফাজতের নেতাকর্মী বা সমর্থক। তাই যখনই মুসলমানের স্বার্থ সংরক্ষণের ডাক আসবে তখন দল-মত নির্বিশেষে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় ভুলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’
সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘ওলামায়ে কেরাম নবী-রাসূলের উত্তরসূরী। তাদের বন্দি রেখে দেশে শান্তি এবং স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। দেশের এই ক্রান্তিকালে অশান্তি ও দুরবস্থা থেকে মুক্তি এবং সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রথমত হেফাজত নেতাকর্মীদের নামে করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন। তাদেরকে দ্রুত মুক্তি দিয়ে মজলুমদের কান্না বন্ধ করুন।’
সম্মেলনের প্রধান আলোচক সংগঠনটির মহাসচিব সাজিদুর রহমান বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ দেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। হেফাজত ১৩ দফা বাস্তবায়নের পক্ষে আগের মতোই নিজেদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘২০১১ ও ২০১৬ সালে শিক্ষানীতি নিয়ে ষড়যন্ত্র হলে আল্লামা শাহ আহমদ শফির বাধার মুখে সেই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে যায়। আমরা জানতে পেরেছি সেই ষড়যন্ত্র আবারো শুরু হয়েছে। এবার তারা ধর্মীয় শিক্ষার পরীক্ষাই বাতিল করে দিচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না।
‘অবিলম্বে জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ইসলামবিদ্বেষী লেখাগুলো বাদ দিতে হবে। সব শ্রেণিতে ধর্মীয় শিক্ষার ওপর ১০০ নম্বরের পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।’
বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সা’দ আসার বিপক্ষে হেফাজত
সম্মেলনে হেফাজত মহাসচিব বলেন, “দিল্লির মাওলানা সা’দ সাহেবের বাংলাদেশে আসাকে কেন্দ্র করে ২০১৯ সালে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। বাংলাদেশের দাওয়াতে তাবলীগের মধ্যে নজিরবিহীন বিভেদ তৈরি হয়েছে।
“আমরা জানতে পেরেছি এবারও ইজতেমা উপলক্ষে তিনি বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশে এলে একটি বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হবে। তাই আমাদের দাবি, মাওলানা সা’দ সাহেবকে কোনোভাবেই যেন বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়া না হয়।”
নায়েবে আমীর আতাউল্লাহ হাফেজ্জী বলেন, ‘আমরা মাঠে নামব। অনেক সময় বলা হয় হেফাজত অরাজনৈতিক দল, তারা মাঠে কেন নামবে। আমি বলি শিক্ষার্থী বা অনেকে তাদের দাবির জন্য মাঠে নামে। সেটা কি রাজনৈতিক আন্দোলন হয়ে যায়?’
সংগঠনটির নায়েবে আমীর আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে। নয়তো এদেশে হেফাজত নেতা-কর্মীদের নিয়ে এমন আন্দোলন করা হবে যে সরকার থামাতে পারবে না।’
এছাড়া সম্মেলনে দলটির পক্ষ থেকে তিনটি কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জেলা-উপজেলা কমিটি গঠন; দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে শানে রেসালত সম্মেলন এবং রাজধানীতে জাতীয় শানে রেসালাত সম্মেলন।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র নায়েবে আমির ইয়াহিয়া, মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী, ফুরকানউল্লাহ খলিল, যুগ্ম মহাসচিব মুহিউদ্দীন রাব্বানী, হেফাজতের ঢাকা মহানগর সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আবদুল কাইয়্যুম সুবহানী এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদরীস।
হেফাজতের ৭ দফা
সম্মেলনে হেফাজতের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সাত দফা দাবি তুলে ধরা হয়। তা হলো-
১. অবিলম্বে হেফাজত নেতাকর্মী ও আলেম-উলামাদের মুক্তি দিতে হবে।
২. হেফাজত নেতাকর্মীদের নামে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. ইসলাম ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস করতে হবে।
৪. কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে।
৫. শিক্ষা কারিকুলামে ধর্ম শিক্ষার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৬. জাতীয় শিক্ষা কমিশনে হাইয়াতুল উলাইয়ার প্রতিনিধি থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৭. বিশ্ব ইজতেমায় বিতর্কিত মাওলানা সা’দ সাহেবকে আসার অনুমতি দেয়া যাবে না।