ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) দাবির বিষয়ে পরিষ্কার হতে পারেননি বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধিদল বৃহস্পতিবার মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে তথ্যপ্রমাণ ও সিসিটিভি ফুটেজ দেখার পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান। ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদলকে তথ্যপ্রমাণ দেখান গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
পরে শিক্ষার্থীরা সাংবাদিকদের বলেন, ডিবি যেসব আলামত উপস্থাপন করেছে সেগুলো আত্মহত্যা প্রমাণে যথেষ্ট নয়। তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশপ্রধানের দাবি, তথ্যপ্রমাণ দেখার পর তদন্ত নিয়ে সন্তোষ জানিয়েছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।
ডিবি কার্যালয় থেকে বের হওয়ার পর এক শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফারদিন মৃত্যুর ঘটনায় ডিবি আমাদের কিছু আলামত দেখিয়েছে। আমাদের সেগুলো প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তবে কিছু কিছু জায়গায় কিছু গ্যাপ রয়েছে। ডিবির পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে এই গ্যাপগুলো নিয়ে তারা আরও কাজ করবেন।
‘তারা বলেছেন এ ঘটনায় শতভাগ তথ্যপ্রমাণ সরবারহ করা সম্ভব নয়, তবে সামনে আরও কাজ করবেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘একটা অন্যতম গ্যাপ হলো সুলতানা কামাল ব্রিজ পার হয়ে ফারদিন লেগুনা থেকে নেমেছিল, সে সময়ের কোনো ফুটেজ তারা (ডিবি) দেখাতে পারেনি। সে সময় ফারদিন একা ছিল নাকি সঙ্গে কেউ ছিল তা আমাদের দেখানো হয়নি।
‘একইভাবে ফারদিন যে হেঁটে ব্রিজে এসেছে সেটাও দেখা যায়নি। লেগুনা চালক ডিবির কাছে বলেছে ফারদিনের সঙ্গে আরও একজন লেগুনা থেকে নেমেছিল, আমরা ওই ব্যক্তির বিষয়ে কোনো তথ্য পাইনি।’
শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদল জানায়, ডিবির পক্ষ থেকে যেসব আলামত দেখানো হয়েছে সেগুলো প্রাসঙ্গিক এবং তাদের তদন্তের ধরন ও আন্তরিকতায় তারা সন্তুষ্ট।
এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ডিবি কিছু সম্পূরক তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছে যাতে ফারদিনের মৃত্যু আত্মহত্যা মনে হতে পারে, কিন্তু এসব তথ্যপ্রমাণে মোটিভ পরিষ্কার হয় না যে ফারদিন আত্মহত্যাই করেছে। মোটিভ পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিতভাবে আত্মহত্যা বলতে পারব না।’
সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানায় শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদল।
বুয়েট শিক্ষার্থীরা ‘সন্তুষ্ট’
বুয়েট শিক্ষার্থীরা ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়ে পরিষ্কার না হওয়ার কথা জানালেও ডিবি প্রধান মো. হারুন অর রশিদ পরে সাংবাদিকদের জানান শিক্ষার্থীরা সব দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা সব তদন্ত শেষে একটা কথা বলি যে পরবর্তীতে মামলা সংশ্লিষ্ট কোনো আলামত পাওয়া গেলে তা পুনরুজ্জীবিত করা হবে, তদন্ত করা হবে। আমরা সেটাই বলেছি, এর বেশি কিছু নয়। ওনারা (শিক্ষার্থীরা) আমাদের গ্যাপ দেখাবেন কেন, আমরা তাদের সব বুঝিয়ে বলেছি।
‘কেউ যদি দরজা বন্ধ করে আত্মহত্যা করে সেটা তো আর কেউ দেখে না। তারা গ্যাপ বলতে জানতে চেয়েছেন, ফারদিন যে ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বা তাকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল কিনা এটা কেউ দেখেছে কিনা। এখন ফারদিন যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে আত্মহত্যা করবেন তখন তো তিনি চাইবেন এটা যেন কেউ না দেখে। আমরা শুধু এটাই বলেছি পরবর্তীতে নতুন কিছু সামনে এলে খতিয়ে দেখা হবে।’
ফারদিনের আত্মহত্যার মোটিভ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফারদিনের মানসিক অবস্থার কথা আমরা আপনাদের বলেছি। এমনকি বুশরাকে নামিয়ে দিয়ে তিনি একা একা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছেন, কোনো জায়গায় তার সঙ্গে কেউ ছিলেন না।
‘তিনি এটেম্পট নিয়েছিল বাবুবাজার ব্রিজের ওখানে, কিন্তু সেখানে অনেক লোক থাকায় ঝাঁপ দেননি। সেখান থেকে গেলেন জনসন রোড, সেখান থেকে গুলিস্তান, এরপর গেলেন যাত্রাবাড়ী, যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় করে সুলতানা কামাল ব্রিজের ওখানে গেছেন।’
হারুন অর রশিদ বলেন, ‘৩৮ দিন তদন্তের পর আমরা বলেছি এটা একটা সুইসাইডাল ঘটনা, কেউ তাকে মারেনি। আজকে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আমরা তিন ঘণ্টা ধরে সব তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছি। আমরা সব যুক্তি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপস্থাপন করেছি। তাদের বুঝিয়েছি যে, এই এই কারণে ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন।
‘গত দুই বছরে ফারদিনের মুঠোফোনের লোকেশন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তিনি আগে কখনও বাবুবাজার ব্রিজ বা সুলতানা কামাল ব্রিজে যাননি। দুই বছরে ৫২২টি নম্বরে ফারদিন কথা বলেছেন, তাদের সঙ্গেও আমরা কথা বলেছি।
‘এছাড়া ফারদিন মানুষের ৩০ বছরের বেশি বাঁচা উচিত নয় এমন মতাদর্শের দুই দার্শনিকের বই পড়তেন এবং তাদের মতাদর্শকে ধারণ করতেন। এসব বিষয় নিয়ে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে নানান সময়ে আলোচনা করেছেন। তাছাড়া ফারদিন তার কয়েকজন বন্ধুকে বলেছিলেন যে কোনো এক শুক্রবারে কারও আত্মহত্যার খবর পওয়া যাবে। ফারদিন নিজেও শুক্রবারেই আত্মহত্যা করেছেন। এটাতে আমরা আরও নিশ্চিত হয়েছি।’
ডিবিপ্রধান বলেন, ‘সুরতহাল প্রতিবেদনে কোনো আঘাতের চিহ্ন না পাওয়া, ধস্তাধস্তির কোনো আলামত না পাওয়া, তার গায়ের জামার কোনো বোতাম পর্যন্ত ছেঁড়েনি, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনি যে ব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন সেটাও ফুটেজে দেখা গেছে। তাছাড়া তার মোবাইল, টাকা, ঘড়ি সবই তার সঙ্গে ছিল।
‘এর বাইরে ফারদিন ছিলেন ইন্ট্রোভার্ট। তার রেজাল্ট ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছিল। এসব কিছু ফারদিন তার পরিবারে জানাননি। তার পরিবার তাকে বাসায় থাকতে বলতেন, কিন্তু তিনি বাসায় থাকতে চাইতেন না। সব কিছু মিলিয়ে আমরা বলেছি এটা আত্মহত্যার ঘটনা। এসব জানার পর বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন যে এটা আত্মহত্যা।’
তিনি বলেন “ঘটনার রাতে (৪ নভেম্বর) বুশরাকে নামিয়ে দেয়ার পর ফারদিনের সঙ্গে বুশরার একবারই ম্যাসেজের মাধ্যমে কথা হয়েছিল। বুশরা জানতে চেয়েছিলেন, ফারদিন বাসায় পৌঁছেছেন কিনা। এর উত্তরে ফারদিন শুধু উত্তর দিয়েছিলেন ‘ইয়েস’।
“এ ঘটনায় বুশরার কোনো সম্পৃক্ততা আমরা পাইনি, এটা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করব। এরপর বুশরাকে ছাড়া হবে কিনা সেটা আদালত সিদ্ধান্ত জানাবেন।”
এর আগের দিন বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশপ্রধান হারুন অর রশীদ।
মিন্টো রোডে নিজ কার্যালয়ে তিনি বলেন, ‘সবকিছু জিজ্ঞাসাবাদ, ডাক্তার সাহেব যে কথাটা বলেছেন, ভিকটিমের কাপড়ে কোথাও ছেঁড়ার কোনো লক্ষণ আমরা পাইনি। তাকে যে মারপিট করা হয়েছে এমন কোনো চিহ্ন ছিল না। ধস্তাধস্তি বা আঘাতের চিহ্নও নেই।’
ঢাকার ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফারদিন লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলেও জানান হারুন অর রশীদ।
একই দিন র্যাবের পক্ষ থেকেও জানানো হয়, সেতু থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন বুয়েট ছাত্র ফারদিন নূর পরশ।
ফারদিন ৪ নভেম্বর নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। বর্তমানে হত্যা মামলাটির তদন্ত করছে ডিবি। পাশাপাশি র্যাবসহ আরও কয়েকটি সংস্থা ছায়াতদন্ত করছে।
পুলিশি তদন্তে জানা যায়, নিখোঁজ হওয়ার দিন বিকেল থেকে রাত ১০টা নাগাদ বুশরাকে নিয়ে রাজধানীর কয়েকটি জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন ফারদিন। এরপর রামপুরায় বুশরা যে মেসে থাকেন তার কাছাকাছি তাকে পৌঁছে দেন। এরপর আর ফারদিন বুয়েট ক্যাম্পাস বা নিজের বাসায় ফেরেননি।
ফারদিনের মরদেহ উদ্ধারের তিন দিনের মাথায় ১০ নভেম্বর আমাতুল্লাহ বুশরার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা ও পরিকল্পিতভাবে লাশ গোপন করার অভিযোগ এনে রামপুরা থানায় মামলা করেন তার বাবা কাজী নুরউদ্দিন রানা।
ওই দিনই বুশরাকে গ্রেপ্তার করে রামপুরা থানার পুলিশ। তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। বুশরা এখন কারাগারে আছেন।