মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিলের নির্দেশে বরিশালের বেলস পার্কে গোপন বৈঠকে অংশ নেন সেকেন্দার আলী মিয়া। সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরই ৯ নম্বর সেক্টরের মধ্যে ঝালকাঠির নলছিটি থানা কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় তাকে। বরিশাল বিভাগের সবচেয়ে বড় সম্মুখযুদ্ধ হয় ঝালকাঠির চাচৈর গ্রামে। সেখানে সম্মুখযুদ্ধে তার গুলিতে সাত পাকিস্তানি মিলিটারি নিহত হয়। এরপর পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী।
একে একে তিনি অংশ নেন কাঁঠালিয়া, বাকেরগঞ্জ ও দরগাবাড়ির সম্মুখযুদ্ধে। নলছিটি ও কাঁঠালিয়া থানা আক্রমণ করে নিরস্ত্র করেছেন পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীকে।
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা সেকেন্দার আলী মিয়া বর্তমানে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। স্ত্রী এবং মাসুদ নামের ৪৫ বছর বয়সী এক সন্তান ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে বাড়িতেই দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে সেকান্দার মিয়া বলেন, ১৯৬৪ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দিয়েছিলাম। পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিল আমার কর্মস্থল। পরে আমাকে যশোরে বদলি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায় সেনাক্যাম্পে। সৈনিকের চাকরি ফেলে সেখান থেকে পালিয়ে ঝালকাঠির নলছিটিতে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টা। ঝালকাঠির চাচৈর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প ছিল। সেখানে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলাম পাকিস্তানি মিলিটারিদের কীভাবে হটানো যায়। এরই মধ্যে ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর খবর পাঠান, পাকিস্তানি আর্মিরা রাজাকারদের নিয়ে আসছে আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতে। খবরটি পাঠানোর ঘণ্টাখানেক পরে তিনিও (ক্যাপ্টেন সাহেব) মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে ক্যাম্পে এলেন। অন্যদিক থেকে সুলতান মাস্টারও একদল মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এলেন। মান্নান এলেন আকেটি দল নিয়ে। চারপাশ থেকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে এলেন। চান মিয়া নামের এক ছেলেকে সামনে পাহারায় রাখি।
‘কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই গাড়ির শব্দ। আচমকা গাড়ির শব্দ শুনে সহযোদ্ধাদের মন আঁতকে উঠছিল। চান মিয়া ভুল করে একটি ফায়ার করল। ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি সাতটি গাড়িতে করে এক শরও বেশি পাকিস্তানি হানাদার এসেছে। আমি সাহস হারাইনি। সবাইকে সাবধান হতে বলি। আমার কাছে একটি এলএমজি ও অন্যদের কাছে ৭০-৮০টি (থ্রি নট থ্রি) রাইফেল ছিল। তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
স্মৃতি হাতড়ে সেকান্দার মিয়া বলতে থাকেন, ‘আমাদের ক্যাম্পের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। আমরাও চারদিক থেকে গুলি চালাই। সম্মুখযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রাশফায়ারে সহযোদ্ধা আবদুল আউয়ালের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নির্বাক সহযোদ্ধার মৃত্যু দেখলাম। কিছুই করার ছিল না। এরপর জীবন বাজি রেখে নেমে পড়ি যুদ্ধে। একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকি। একপর্যায়ে আমার ছোড়া গুলিতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাতজন নিহত হয়। প্রবল বাধার মুখে পিছু হটতে শুরু করে তারা। ৯ নম্বর সেক্টরের সবচেয়ে সফলতম যুদ্ধ ছিল চাচৈর যুদ্ধ।’
এ যুদ্ধের সংবাদ পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক রেডিও স্টেশনগুলো থেকেও প্রচার করা হয় বলে জানান তিনি। বলেন, ‘ওই রাতেই আমার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নলছিটি থানা আক্রমণের উদ্দেশে রওনা হয়। আমরা তখন ছিলাম দুই গ্রুপে ৪০ জন। থানার ভেতরে থাকা পুলিশের অবস্থান বোঝার জন্য ফায়ার করি। পুলিশ আমাদের অবস্থান আঁচ করতে পেরে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। একটি গুলি এসে লাগে সহযোদ্ধা আলমের গায়ে। তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। পরে আমরা সামনের দিকে আর যাইনি। এরই মধ্যে আরেকটি গুলি এসে লাগে মালেকের গায়ে। তিনিও নিহত হন। এরপর আমরা অবস্থান ত্যাগ করি। চলে যাই বাহাদুরপুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। ১৪ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী থানা আক্রমণের খবর পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা দেওপাশা ও পরমপাশা গ্রামের বেশ কয়েকটি বাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।
‘গ্রামবাসীর এ বিপদের মুহূর্তে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের সঙ্গে আলতাফ মাহমুদ ও কবির হোসেন শীতলপাড়া পুলের নিচে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে দুজনই নিহত হন। তাদের রক্ষা করতে গিয়ে সুবেদার করিম আহত হন। আমরা তখন ক্ষিপ্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমাদের গুলিতে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। পিছু হটতে শুরু করে তারা।’
নলছিটি দোসর মুক্তের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, ‘৭ ডিসেম্বর আমরা নলছিটি থানা আক্রমণের প্রস্তুতি নিলাম। চারপাশ থেকে ঘিরে রেখে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালাই। পুলিশ বাহিনী নিশ্চিত পরাজয় ভেবে ৮ ডিসেম্বর নলছিটি থানার এসআই সিদ্দিক হোসেন তার পুলিশ বাহিনী, রাজাকার আলবদরদের নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আর এই দিন দোসরমুক্ত হয় নলছিটি।’
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ঝালকাঠি ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা দুলাল সাহা বলেন, সংগ্রাম চলাকালীন সেকান্দার আলী খুব সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। ওই সময়ের ভয়াবহ স্মৃতি আজও চোখের সামনে ভাসে। অনেক কষ্ট করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি।’