বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী বোমার খোলস

  •    
  • ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৯:৫৬

যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক-হানাদার বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ঈশ্বরদী আসছিল। এসময় তাদের আসা ঠেকাতে ভারতীয় যুদ্ধবিমান থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ লক্ষ্য করে চার থেকে পাঁচটি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। একটি বোমা পড়েছিল পাকশী রেলস্টেশনের ৫০ গজ দূরে, পশ্চিমের পদ্মার বালুচরে। সেদিন বোমাটি বিস্ফোরিত না হয়ে অক্ষত ছিল। পরে বালুচরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর। দুপুর ১২টার পর থেকেই ভারতীয় পাঁচটি যুদ্ধবিমান ঈশ্বরদীর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে চক্কর দিতে থাকে। ওই সময়ে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক-হানাদার বাহিনী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে ট্যাংক, কামান, জিপ পার করে ঈশ্বরদী আসছিল। এসময় তাদের আসা ঠেকাতে ভারতীয় যুদ্ধবিমান থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ লক্ষ্য করে চার থেকে পাঁচটি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। একটি বোমার আঘাতে ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানের একদিকের অংশ ভেঙে নদীতে পড়ে।

একটি বোমা পড়েছিল পাকশী রেলস্টেশনের ৫০ গজ দূরে, পশ্চিমের পদ্মার বালুচরে। সেদিন বোমাটি বিস্ফোরিত না হয়ে অক্ষত ছিল। পরে বালুচরে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ওই বোমার খোলসটি দেখতে প্রতিদিনই নানা বয়সের মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন।

দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৫ সালে ভারত সরকার ব্রিটিশ আমলের নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের অন্য সব গার্ডারের সঙ্গে মিল রেখেই ১২ নম্বর স্প্যান প্রতিস্থাপন করে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপকের (ডিআরএম) কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায়, নিরাপত্তার বেষ্টনীতে বোমার খোলসটি রাখা রয়েছে। লাল-সাদা রং দিয়ে সিমেন্টের বেদীর ওপর সযত্নে গাঁথা রয়েছে।

উত্তরবঙ্গের রেল শ্রমিকনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশীদূল্লাহ স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ঠিক বিজয়ের দুই দিন আগে ঈশ্বরদীতে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে তখনও যুদ্ধ চলছিল। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা সেদিন ঈশ্বরদীর দিকেই আসছিল। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা পাকশী দিয়ার বাঘইল-সাহাপুরের মাঝামাঝি অবস্থান করছিলাম। পাকিস্তানি সেনারা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল। পাকশী-বাঘইল রেললাইনের টানেলের লাইনের ধারে বসে পাকিস্তানি সেনাদের কাঁচা বেগুন খেতে দেখা যায়।

“আমাদের সঙ্গে জীবন নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি পাবনার ছেলে, পাঞ্জাবি ভাষায় পাক সেনাদের সঙ্গে কথা বলেন। জীবন পাঞ্জাবি ভাষাতেই আত্মসমর্পণের কথা বলেছিলেন ওদের। ওদের শেষ বাক্য ছিল ‘এ্যাহ স্যালে বাঙালি হ্যায়’। সেকেন্ডের মধ্যে তারা গুলি ছুড়তে থাকে। আমরাও তখন পাল্টা গুলি চালায়। এসময় আমরা একত্রিত হয়ে অনেক পাকিস্তানি সেনাকে ঘিরে ফেলি।”

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেল ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ের সামনে সংরক্ষিত বোমার খোলস। ছবি: নিউজবাংলা

স্মৃতিচারণ করে পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের তৎকালীন ছাত্র পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল ইসলাম বলেন, ‘পাক বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফেলেছিল। এ খবর পেয়েই পাকিস্তানি সেনারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বাধ্য হয়ে দুইজন ইপিআরের মাধ্যমে দমদম এয়ারপোর্টে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কমান্ডারের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সাহায্য চাই। দুপুরের পর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপরে পাঁচটি যুদ্ধবিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। একটি বোমার আঘাতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের একটি স্প্যান ভেঙে পদ্মা নদীতে পড়ে। আরেকটি বোমা পাকশী স্টেশনের কাছে পড়েছিল। এতে সেখানে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। আরেকটি বোমা বালুচরের মধ্যে পড়েছিল।’

হাবিবুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সেদিন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ সংযোগের তারের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের মরদেহ। পাক সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংক ব্রিজের ওপর পড়ে ছিল। ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার কারণে পাকিস্তানি সেনারা সেটি পার করতে পারেনি।’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের সেতু প্রকৌশলী (ব্রিজ) আব্দুর রহিম জানান, স্বাধীনতার পর ভারত সরকার স্প্যানটি নির্মাণ করে। ব্রিটিশ সরকারের জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকো দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্প্যানটির নির্মাণকাজ করা হয়। সেসময় পদ্মা নদীর মাঝে ঝুলে থাকা স্প্যানটি এতটাই ভারী ছিল যে সেটি নদী থেকে তোলা আর সম্ভব হয়নি। দেশে রেলওয়ের যোগাযোগ রক্ষার স্বার্থে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভারত সরকার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ স্প্যান নির্মাণ করার পর ওই বছর থেকে সেতুটি দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়।

পাকশী রেলওয়ে শ্রমিকলীগ সভাপতি ইকবাল হায়দার জানান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পাকশী রেলওয়ের বিভাগীয় সদর দপ্তরের সামনে বোমার খোলসটি রেখে দেয়া হয়েছে। নতুন প্রজন্ম বোমার খোলসটি দেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুভব করে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) শাহ সুফী নুর মোহাম্মদ জানান, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর আজও বোমার খোলসটি এই এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের একটি স্মৃতি হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী বোমার খোলসটি দেখার জন্য অনেক দর্শনার্থী এখানে আসে। জাতীয় দিবসের আগে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ের পক্ষ থেকে নিয়মিত বোমার খোলসটি পরিষ্কার, সংরক্ষণ ও রং করা হয়।

এ বিভাগের আরো খবর