যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর আবার ক্ষোভ ঝাড়লেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছেন, সে দেশের সরকার খুনিদের মানবাধিকার রক্ষায় ব্যস্ত।
তিনি এ-ও বলেছেন, আওয়ামী লীগ মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না বরং নিশ্চিত করে। শুধু মানুষের জীবন বাঁচানো নয়, খাদ্য নিরাপত্তা, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টাও করে।
বিএনপি দেশকে সন্ত্রাসের রাজত্বে পরিণত করেছিল বলে অভিযোগ তার। বলেছেন, তারা দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার, এতিমদের টাকা আত্মসাৎ করে দেশকে খুনের অভয়ারণ্য বানিয়েছিল।
বুধবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দলের এক আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমেরিকা ও কানাডা খুনিদের মানবাধিকার রক্ষায় ব্যস্ত। জাতির জনকের সাজাপ্রাপ্ত খুনিদের ফেরত দিতে বলি, তারা দেয় না। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর মানবাধিকার রক্ষা করছে তারা।’
গত তিন সপ্তাহের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ জানালেন শেখ হাসিনা। গত ২৫ নভেম্বরের এক আলোচনায়ও তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিকে ফেরত না দেয়ায় দেশটিকে একহাত নেন।
সেদিন তিনি বলেন, ‘অবশ্য আমেরিকার কারবারই এ রকম। এখানে যখন একজন ড্রাগ ডিলার, যখন ড্রাগসহ তাকে ধরতে গেছে পুলিশ তাদের ওপর হামলা করেছে, র্যাব ধরতে গেছে হামলা করেছে। ১৪টা মামলার আসামি এবং ড্রাগসহ ধরা পড়ে তার গ্রুপ পুলিশের ওপর গুলি করে, র্যাবের ওপর গুলি করে, তারপর সে-ও গুলি খায়, মারা যায়। তার জন্য আমাদের দেশের কিছু লোক বিভিন্ন জায়গায় তদবির করে বেড়ায়।
‘অথচ এই ড্রাগ ডিলারদের খোঁজ আনতে যেয়ে, ধরতে যেয়ে আমাদেরই একজন এয়ার ফোর্সের অফিসার, তাকে ড্রাগ ডিলাররা অপহরণ করে নিয়ে যায়, অত্যন্ত নির্মমভাবে তাকে মারে, হত্যা করে।
‘এ ব্যাপারে তাদের কিন্তু উদ্বেগ নেই, মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও উদ্বেগ নেই বা যারা আমাদের ওপর স্যাংশন দেয়, আমেরিকা, তাদেরও কোনো উদ্বেগ নেই, কারও কোনো উদ্বেগ নেই। কেমন একটা অদ্ভুত বিশ্ব পরিস্থিতি, সেটাই আমার অবাক লাগে।’
- আরও পড়ুন: আমেরিকাকে একহাত নিলেন প্রধানমন্ত্রী
বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয় বছর পর দেশে ফিরে ইনডেমনিটি আইনের কারণে বিচার চাইতে না পারার কথা তুলে ধরে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘তখন কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মানবাধিকার নিয়ে তো আমি প্রশ্ন করতে পারি। কেন আমি বাবা-মার লাশ দেখতে পারিনি। কেন রেহানার পাসপোর্ট রিনিউ করেনি জিয়াউর রহমান? কেন আমাকে ছয় বছর দেশে আসতে দেয়নি? সে জবাব কী তারা দেবে? কার কাছে দেবে?’
আমেরিকাকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘কোন জঙ্গি, মাদক ব্যবসায়ী কারা মারা গেছে, সেটা নিয়ে ব্যস্ত তারা।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ৮১তে ফিরে এসে আমার বাবা-মায়ের হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করতে যাই, মামলা নিল না। ইনডেমনিটি আছে, বিচার চাইতে পারলাম না। ১৫ আগস্টে যারা স্বজন হারিয়েছি, তারা বিচার চাইতে পারিনি। এটা কোনো আইন? তারা জাতির জনকের খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দিয়েছে।’
‘কোন মুখে গুমের কথা বলে বিএনপি’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘বিএনপির লোকে গুম খুন নিয়ে কথা বলে। এ দেশে গুম শুরু করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। ফাঁসি দেয়ার সংস্কৃতিও তার। একদিনে দশজনকে ফাঁসি দিয়েছে। কত মানুষকে জিয়াউর রহমান হত্যা করেছে!
‘এক বিমান বাহিনীর ৫৬২ জন, সেনা ২ হাজার অফিসার ও সৈনিক। সে পরিবারগুলো আজও তাদের আপনজনের জন্য কেঁদে ফেরে। কই, মরদেহের খবরটাও তো পায়নি।
‘আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মীকে গুম করেছে। একই কায়দায় বারবার অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে। সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের হত্যা করেছে। সেনাবাহিনী-বিমান বাহিনী থেকে অসংখ্য লোকজনকে গুম করেছে, বহু মানুষকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তাদের লাশ মাটি চাপা দিয়ে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, তাদের আত্মীয়স্বজন আজও জানে না কোথায় সেসব লাশ।
‘দেশের প্রতিটা কারাগারে ফাঁসি দিয়েছে। ক্যান্টনমন্টে হত্যা করে লাশ লুকিয়েছে। এমনও শোনা যায়, কাটা চামচ দিয়ে নাস্তা করার সময়ও অনেকের ফাইল সই করে তাদের খুন করেছে। এরপর কোন মুখে বিএনপি গুম-খুন নিয়ে কথা বলে?’
‘আওয়ামী লীগ মানবাধিকার রক্ষা করে’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার এ দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, চিকিৎসাসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে, শিক্ষা নিশ্চিত করেছে, আয়ু বৃদ্ধি করেছে।
‘অবকাঠামোর উন্নয়ন করেছে, গৃহহীনদের থাকার ঘর দিয়েছে, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ফেরাতে চুক্তি করেছে। ভারত থেকে ৬৪ হাজার শরণার্থী ফেরত এনে পুনর্বাসন করেছে। কাজেই আওয়ামী লীগ মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এর সুরক্ষা দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি এ দেশকে সন্ত্রাসের রাজত্বে পরিণত করেছিল। তারা দুর্নীতি, লুটপাট, টাকা পাচার, এতিমদের টাকা আত্মসাৎ করেছে। দেশকে খুনের অভয়ারণ্য বানিয়েছিল।
‘দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে। শুধু তা-ই নয়, যারা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, খালেদা জিয়া তাদের প্রমোশন দেন, আর ৩ নভেম্বর জেলহত্যার রায়ের প্রাক্কালে আসামিকে চাকরি দিয়ে মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠান।’
‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্মান করে না বিএনপি’
এই অভিযোগ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে বুদ্ধিজীবী দিবস আমরা পালন করি। বিএনপির কি কোনো কর্মসূচি আছে? সেটাতে কী বোঝা যায়। আবার জিয়া-এরশাদ-খালেদা স্বাধীনতাবিরোধীদের বিভিন্ন পদ দিয়েছে।’
বেগম খালেদা জিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তাদের সম্মান আসবে কেমন করে? এইট পাস আর মেট্রিক ফেল, ইন্টারমিডিয়েট ফেল।’
পদ্মা সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে এবং তা ভেঙে পড়বে বলে বেগম খালেদা জিয়ার করা একটি মন্তব্যেরও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘বিএনপি নেতারা কীভাবে পদ্মা সেতুতে চড়েন, তাদের কি লজ্জা হয় না?’
দুর্নীতির মামলায় বিএনপি নেত্রীর সাজার বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এক এগারোর সময় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিল তারই নিজের লোক ফখরুদ্দিন-ইয়াজউদ্দিন, মঈন উদ্দিন।
‘এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন খালেদা জিয়া। এতিমদের টাকা তার একাউন্টে ছিল, এতিমরা এক টাকাও পায়নি।’
ক্ষমতায় থাকার সময় খালেদা জিয়া তার বিরুদ্ধে ১২ টি মিথ্যা মামলা দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগ করেন শেখ হাসিনা।
আলোচনায় বক্তব্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, স্বাস্থ্য সম্পাদক রোকাইয়া সুলতানাও বক্তব্য দেন।
সভাটি যৌথভাবে সঞ্চালনা করেন দলের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম।