বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কুমিল্লার ৩৫ বধ্যভূমি অরক্ষিত

  •    
  • ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৬:০০

মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশসহ নানা পেশার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেয় পাক বাহিনী। ৫২ বছর পরেও এসব গণকবর ও বধ্যভূমির অধিকাংশ শনাক্ত কিংবা সংরক্ষণ করা হয়নি। অবহেলা-অনাদরে অধিকাংশ বধ্যভূমির স্থান ঝোপ-জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

কেউ ধান শুকাচ্ছেন, কোথাও গরু-ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও জায়গাটা পরিত্যক্ত মনে করে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত মাদকসেবীরা আসর বসায়। কুমিল্লায় বেশ কয়েকটি বধ্যভূমির চিত্র এটি।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে কুমিল্লার প্রায় অর্ধশত বধ্যভূমি। এর ৩৫টিই সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার রসুলপুর বধ্যভূমি। এমন ডিসেম্বর মাসেই পাঁচ শতাধিক মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। এই গণকবর থেকে বেঁচে ফেরা মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ বলেন, ‘গণকবরের এই দশা দেখলে আমার কষ্ট হয়। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে অ্যামবুশ করে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে হত্যা করি। অস্ত্র কম থাকায় সেদিন পুরেপুরি মিশন শেষ করতে পারি নাই। তবে আমরা দূর থেকে দেখেছি, লাইনে নর-নারীদের দাঁড় করিয়ে রেখে গুলি করে কীভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদারেরা। তারপর সেই লাশগুলো আধা কবর দেয়া হয়। রাতের বেলায় শিয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হয়েছিল দেশের জন্য জীবন দেয়া মানুষগুলো।

‘আজ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর কেউ তাদের মনে রাখে নাই। বছরে এক দুই দিন সবাই এসে ফুল দেয়। এগুলো দেখলে কষ্ট হয়। ইতিহাস বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংরক্ষণ না হলে আগামী প্রজন্ম কীভাবে জানবে এই দেশকে স্বাধীন করতে কত তাজা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে?’

মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার প্রশাসনের কর্মকর্তা, পুলিশসহ নানা পেশার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেয় পাক বাহিনী। ৫২ বছর পরেও এসব গণকবর ও বধ্যভূমির অধিকাংশ শনাক্ত কিংবা সংরক্ষণ করা হয়নি। অবহেলা-অনাদরে অধিকাংশ বধ্যভূমির স্থান ঝোপ-জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। অনেকগুলোর চিহ্নও নেই, জানা নেই শহীদদের সংখ্যাও।

এমন আরেকটি গণকবর দেখা যায় কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ধনঞ্জয় গ্রামে। একই বাড়ির অন্তত ৩৫ জনকে ব্রাশফায়ার করে গণকবর দেয়া হয় এখানে। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে দায় সারা হয়েছে। বছরে একবার ফুলও জোটে না, স্মরণ করা হয় না সেসব মুক্তিকামী মানুষকে।

কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস বলছে, ৩২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে ফলক উন্মোচন করা হয়েছে। বাকিগুলো সরকারি সহযোগিতা পেলে চিহ্নিত করা হবে। সংরক্ষণ ও সঠিক ইতিহাস তুলে না ধরার কারণে জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও স্মৃতির কথা অজানা রয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণীর কাছে।

এ জেলার গণকবর ও বধ্যভূমিগুলোর অন্যতম সদর উপজেলার রসুলপুর বধ্যভূমি, রামমালা বধ্যভূমি, সদর দক্ষিণের জগতপুর গণকবর, চৌদ্দগ্রামে বেতিয়ারা গণকবর, নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি, দেবিদ্বার বধ্যভূমি, লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি ও কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি।

রসুলপুরে গিয়ে দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে বদ্ধভূমির ওপর উপড়ে পড়া একটি গাছ কেউ সরিয়ে নেয়নি। স্থানীয়রা বধ্যভূমির চত্বরে ধান শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। স্থানীয়রা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘এখানে মাদকের আসর বসে প্রতিদিন। ডিসেম্বর মাস এলে দুই-একজন লোক শহর থেকে আসে। সারা বছর তো কারও কোনো খবর দেখি না।’

অযত্নে পড়ে আছে আরও বেশ কিছু গণকবর। তার মধ্যে আছে ময়নামতি, লাকসাম, মুদাফফরগঞ্জ, হারং, বেতিয়ারা কোটেশ্বরসহ অন্যান্য গণকবর।

ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট বধ্যভূমিতে বাঙালি অফিসার, সৈনিক, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহবধূ এবং মসজিদের ইমামকেও কবর দেয়া হয়েছিল। ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অমানুষিক নির্যাতনের পর এই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টেই হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এ বধ্যভূমিতে মোট ১২টি গণসমাধি খনন করে ৭ হাজার নরকঙ্কাল পাওয়া যায়।

কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে কেবিন বরাবর পূর্ব দিকে একটি বধ্যভূমি আছে। কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশ, বৃহত্তর নোয়াখালী এবং চাঁদপুরের বাঙালি যুবক-যুবতী, বৃদ্ধা, শিশুদের এখানে এনে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। হাত-পা বেঁধে গুলি করা হতো। এরপর লাথি দিয়ে ফেলা হতো গর্তে। গুলি খাওয়ার পরেও যারা জীবিত থাকতেন, তাদেরকেও মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে ১০ হাজার বাঙালিকে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

কুমিল্লার মুদাফফরগঞ্জে একদল রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা ৩৭ জন লোককে হত্যা করে। তারা একটি বাড়ি থেকে চার বালিকাকে ধরে এনে গণধর্ষণ করে। তিন-চার দিন পর তাদের মৃতদেহ পাশের একটি খালে ভাসতে দেখা যায়।কুমিল্লার চান্দিনার হাড়ং গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে তার এক খণ্ড জমি পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসররা গণকবর হিসেবে ব্যবহার করত। হত্যার পর এখানে মাটিচাপা দিত লোকজনকে। আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মাকেও এখানে হত্যার পর এখানে মাটিচাপা দেয়া হয়। ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে গণকবর দেওয়া হয়েছে।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা গণকবর। ১৯৭১ সালে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীর যোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। এখানে ৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হয়। বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিস্তম্ভ এখন আগের জায়গায় নেই। মহাসড়কের চার লেনের কাজ হওয়ায় সেটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

কুমিল্লা নগরীর রামমালা এলাকায় অবস্থিত সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভিতরে পুকুরপাড়ে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাক হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ চালায়, তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতরে আশ্রয় নেয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ার করে গণহারে সাধারণ মানুষ ও আনসারদের হত্যা করে। পরে গর্ত করে মরদেহগুলো গণকবর দেয় হানাদার বাহিনী। স্থানীয় সূত্র মতে, এই বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫০০ লোকের সমাধি।

এসব গণকবরে বছরে একদিন বা দুদিন জেলা প্রশাসন উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে পুষ্পস্তবক অর্পণ কিংবা সভা সেমিনার হয়।এই আয়োজন করতে গিয়ে আগের দিন গণকবরে একটু ঝাড়ু দেয়া হয়। সারা বছর সেগুলো পড়ে থাকে অবহেলায়।

কেন গণকবরগুলোর এই অবস্থা– জানতে চাইলে কুমিল্লা মুক্তিযোদ্ধা জেলা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করার কাজ শুরু করেছি। সর্বশেষ শহরের রামমালা বধ্যভূমির সংরক্ষণের কাজ চলমান রয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে চিহ্নিত করা বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ ও সীমানা প্রাচীর দেওয়া হবে।’

কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, ‘আমি কুমিল্লায় সদ্য দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। গণকবর সম্পর্কে নোট নিয়েছি। গণকবর নিয়ে যা কাজ করার দরকার সবই করব।’

এ বিভাগের আরো খবর