সঠিক প্রচার ও প্রদর্শনী এবং রাজধানী থেকে বেশি দূরত্বে প্রতিষ্ঠান হওয়ায় পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন হস্তশিল্প উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে তৃতীয়পক্ষ নিজেদের লাভ উঠিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তারা। তবে প্রচারণার মাধ্যমে ক্রেতা বাড়িয়ে ৫০০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করতে চান সংশ্লিষ্টরা।
সোমবার তিন দিন ব্যাপী ‘ফেয়ার ট্রেড হ্যান্ডিক্রাফট এক্সিবিশন ২০২২’- রাজধানীর বেঙ্গল শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে। প্রদর্শনীর প্রথম দিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হস্তশিল্প উদ্যোক্তা ও আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।
প্রদর্শনীর সহযোগী হিসেবে রয়েছে নরওয়েজিয়ান এজেন্সি ফর এক্সচেঞ্জ কো-অপারেশন (নরেক) ও অন্যান্য হস্তশিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান।
প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে রংপুরের চিলমারীর হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান আনসারী ইনোভেটিভ লার্ন ফর উইমেন। ২৫০ জন দক্ষ কারিগর নিয়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আশরাফুল ইসলাম আনসারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তারা সবাই নারী। প্রত্যেকেই দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে হস্তশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।’
তবে রাজধানী থেকে প্রতিষ্ঠানটির দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের সামনে সহজে পণ্য উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘দূরত্বের জন্য যে সংকটে আমরা পড়েছি তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। আমাকে উৎপাদিত পণ্য অন্য মাধ্যমে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হয়। এতে দেখা যায়, আমি ন্যায্যমূল্য পাই না।
তবে আমার থেকে যারা পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, তারা চড়া দামে একই পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। যদি সরাসরি বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করা যেতো, তাহলে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হতো। আর দেশের হস্তশিল্পের রপ্তানিও কয়েকগুণ বেড়ে যেতো।’
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে তারা নিজেদের পণ্য দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছেন।
এর মাধ্যমে দেশের হস্তশিল্পের গুরুত্ব বিশ্বে তুলে ধরা সম্ভব হবে। বিদেশি ক্রেতার পাশাপাশি দেশি ক্রেতাও বাড়বে।উদ্যোক্তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, হস্তশিল্পের প্রতি দেশীয় ক্রেতাদের থেকে এখনও আশানুরূপ চাহিদার তথ্য পাওয়া যায়নি। এ জন্য বিদেশি উদ্যোক্তাদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়।
প্রদর্শনীর কো-অর্ডিনেটর শাওন আকন্দ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশীয় হস্তশিল্পকে তুলে ধরা। বাংলাদেশে এখনো অনেক মানুষই হস্তশিল্পের বিষয়ে কিছু জানে না। এমন সব মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছানো আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
আজকের প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেশে যে হস্তশিল্প নিয়ে ইনোভেটিভ কাজ হচ্ছে সে সম্পর্কে সবাই জানার সুযোগ পাবেন। পাশাপাশি সবাই যেন হস্তশিল্পের ব্যবহার ও এর সুবিধা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আমাদের উদ্যোক্তাদের তৈরি হস্তশিল্প পণ্যের চাহিদা অনেক। যদি নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে আরও সাপোর্ট পাওয়া যায়, তাহলে খুব দ্রুত এ সম্ভাবনাময় শিল্পটির বিস্তার ঘটানো সম্ভব হবে।’
প্রদর্শনীতে আসা রঙিন মোমবাতি তৈরি করা প্রতিষ্ঠান এমএস মোমবাতির চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার রঙিন মোমবাতির ব্যবসা শুরু ১৯৮৮ সালে। এরপর নানা চড়াই-উৎরাই পার করে আজ সফলতা পেয়েছি। বর্তমানে রঙিন মোমবাতির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।’ তবে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়া কাঙ্খিত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান এ উদ্যোক্তা।
চামড়া দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের হ্যান্ড ব্যাগ, মানিব্যাগ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গুটিপা। প্রতিষ্ঠানটির অপারেশন অ্যান্ড সেলস ম্যানেজার সাইব ইবনে আনোয়ারের সঙ্গে কথা হয়।
তিনি বলেন, ‘মূলত আমরা রপ্তানিযোগ্য পণ্য তৈরি করি। বিদেশে আমাদের ব্যাগের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তবে, প্রদর্শনীতে যেসব পণ্য এসেছে এগুলো শুধু দেশের বাজারের জন্য। আমরা বিদেশে রপ্তানির পাশাপাশি দেশের বাজারও ধরতে চাই।’
হস্তশিল্প প্রদর্শনীতে আগত নরেকের সিনিয়র অ্যাডভাইজর টর রেন্ড বলেন, ‘এ ধরনের প্রদর্শনী বাংলাদেশের হস্তশিল্পকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
এ প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি অনেক ক্রেতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাজানো পণ্য দেখতে পারছেন। এতে বিদেশি ক্রেতাদের পাশাপাশি দেশি ক্রেতারাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের হস্তশিল্পকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে হলে এ ধরনের প্রদর্শনীর কোনো বিকল্প নেই। আমি নিজেও এ প্রদর্শনী থেকে পছন্দ অনুযায়ী অনেক পণ্য কিনেছি।’
একতার সভাপতি ও প্রকৃতি হস্তশিল্পের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘প্রতি অর্থবছরে হস্তশিল্প রপ্তানি বাড়ছে। গত অর্থবছরে হস্তশিল্প রপ্তানি হয়েছে ৪২০ কোটি টাকার। আর চলতি অর্থবছরে এ শিল্প থেকে রপ্তানি টার্গেট ধরা হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা।
আশা করছি এ শিল্পের যথাযথ মূল্যায়ন করা হলে হস্তশিল্প একদিন দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত হবে।’