বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সব দেশের প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত ‘গ্লোবাল হাব অন লোকালি লেড অ্যাডাপটেশন’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি এ আহ্বান জানান।
গনভবন থেকে রোববার সকালে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত ছিলেন সরকারপ্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কার্বন নির্গমনে দায়ী প্রধান সব দেশগুলোকে তাদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদানের সুযোগ আরও বাড়ানোর আহ্বান জানাই। বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে আমাদের সবাইকে আমাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে হবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ক্ষতির কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকার এখন জিডিপির ৬ বা ৭ শতাংশ জলবায়ু অভিযোজনে ব্যয় করে। আমরা সম্প্রতি ২০২৩-২০৫০ মেয়াদি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আমরা নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ২০০৯ সালে একটি জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। এ তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমনের ক্ষেত্রে ৮০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক দুদিক থেকে আমাদের ২৩০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন থেকে অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে ৫০-৫০ বণ্টনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’
জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টায় অংশীদার হতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, ‘আমি প্যারিস চুক্তির আলোকে এই প্রচেষ্টায় আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে আন্তর্জাতিক সরকারি এবং বেসরকারি খাতকে এগিয়ে এসে আমাদের অংশীদারদর হওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’
আজ থেকে চালু হওয়া ‘গ্লোবাল হাব অন লোকাললি লেড অ্যাডাপটেশন’-কে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার অঙ্গীকার করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারা বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরেক সুযোগ তৈরি হওয়ায় আমরা আনন্দিত।’
বাংলাদেশকে ‘গ্লোবাল হাব অন লোকাললি লেড অ্যাডাপ্টেশন’-এর আয়োজক হিসেবে নির্বাচিত করায় গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) ও যুক্তরাজ্যের প্রতি ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহ্য করে আসছে। তারা বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য দুর্যোগেরর বিরুদ্ধে একরকম স্থিতিস্থাপকতা অর্জন করেছে। তারা প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বাংলাদেশকে জলবায়ু অভিযোজন কেন্দ্রে পরিণত করেছে।’
জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও পদ্ধতি রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকার সংস্থান এবং উদ্ভাবনের সঙ্গে সেই পদ্ধতিকে সমর্থন করে। এর মধ্য দিয়ে স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজন ব্যবস্থাগুলোর বিকাশ আমাদের এগিয়ে রাখছে।’
মানুষ ও গৃহপালিত পশুদের আশ্রয় দিতে সারাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, ‘এই আশ্রয় কেন্দ্রগুলো সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে কাজ করে। সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে কোস্টাল গ্রিন বেল্ট কর্মসূচিও অব্যাহত রয়েছে।’
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতি বছর বর্ষায় লাখো বৃক্ষ রোপণ করে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন।’
মুজিব জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১০০টি ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গভীর সমুদ্রসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং সতর্কবার্তা পৌঁছাতে সাহায্য করছে আধুনিক প্রযুক্তি। দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত।’
তিনি বলেন, ‘আমরা লবণাক্ত, খরা এবং বন্যাসহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছি। সবজি উৎপাদনে ভাসমান কৃষি এখন ব্যাপকভাবে প্রচলিত। জলবায়ু সহনশীল মৎস্য ও পশুপালনে অনেক উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এবং তাপ কমাতে জন্য ছাদ কৃষিকে উৎসাহিত করছি।’
বাংলাদেশে নদীগুলোকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের নদীগুলোর নাব্যতা ও পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে ড্রেজিং শুরু করেছি।
‘আমরা উপকূলীয় এলাকার মানুষের জন্য নিরাপদ পানীয় জলের সহজলভ্যতার ব্যবস্থা করেছি। আমরা সেচের উদ্দেশ্যে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করছি। আমাদের কাছে বিশ্বের বৃহত্তম সোলার হোম সিস্টেম রয়েছে।’
নগর পরিকল্পনাও বিভিন্নভাবে জলবায়ু অভিযোজনে সাহায্য করছে বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের নতুন সরকারি ভবনগুলোতে বৃষ্টির জল সংগ্রহের নির্দেশনা দিয়েছি। জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বাড়াতেও আমরা প্রস্তুত।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষের অভিবাসন বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা-দুটোকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলেও মনে করেন টানা তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাগশিপ আশ্রয়ণ কর্মসূচির মাধ্যমে, আমরা গৃহহীন মানুষের জন্য প্রায় এক মিলিয়ন আধা-পাকা দুর্যোগ-সহনশীল বাড়ি তৈরি করেছি। কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় বহুতল আবাসন প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে সেখানে ১৩৯টি বহুতল ভবনে ৫ হাজার জলবায়ু-শরণার্থী পরিবারকে থাকার ব্যবস্থা করেছি।’