বিএনপির আগের বিভাগীয় জনসমাবেশের মতো পরিবহন ধর্মঘটের ঘোষণা নেই। তবে রাজধানীর ভেতরে এবং আশপাশের এলাকা থেকে ঢাকামুখী বাস চলাচল করছে না বললেই চলে। দেখা মিলছে না অটোরিকশা। এমনকি মোড়ে মোড়ে ভাড়ার বাইকের অবস্থানও চোখে পড়েনি।
সাপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিন সড়কে মানুষের চলাচলও কম। আগের রাতে বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের পর আর্জেন্টিনার ম্যাচ বাংলাদেশ সময় ভোর সোয়া ৪টায় শেষ হওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঘুমাতে ঘুমাতে সকাল হয়ে যায়, এটিও একটি কারণ। এর পাশাপাশি রাজধানীর গোলাপবাগে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে উত্তেজনাও মানুষ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
শনিবারের এই সমাবেশকে ঘিরে গত কয়েক মাস ধরেই রাজনীতিতে ছড়াচ্ছিল উত্তাপ। বিএনপির নেতাদের প্রথম ঘোষণা ছিল, ১০ ডিসেম্বর থেকে দেশ চলবে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নির্দেশে। এরপর দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করলেও জনসভা কোথায় হবে, এ নিয়ে বিরোধ থেকে সহিংসতায় প্রাণহানি ও গ্রেপ্তার এবং পুলিশের তল্লাশির কারণে এই দিনটি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ স্পষ্ট।
গত ১২ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপি প্রতি শনিবার ধারাবাহিকভাবে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী শেষে ঢাকার এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা ছাড়া প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশের আগে কোনো না কোনো দাবিতে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। প্রথমে বাস এবং পরে যাত্রী পরিবহনের অন্য যান্ত্রিক গাড়ির মালিক সমিতিও হাঁটে একই পথে।
তবে ঢাকার সমাবেশের আগে মালিক সমিতির পক্ষ থেকে গাড়ি বন্ধের কোনো ঘোষণা আসেনি। তবে বুধবার এই সমাবেশের স্থল নিয়ে নয়াপল্টনে বিএনপি-পুলিশের সংঘর্ষের পর থেকেই সড়কে কমতে থাকে বাস।
বিএনপি সমাবেশটি করতে চেয়েছিল নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে। কিন্তু সড়কে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি পুলিশ। তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ দেয়। অনুমতি ছাড়াই বিএনপি নয়াপল্টনে জড়ো হওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর শুরু হয় সহিংসতা। গ্রেপ্তার করা হয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ পাঁচ শ জনের মতো।
এরপর বৃহস্পতি ও শুক্রবার সমাবেশস্থল নিয়ে তৈরি হয় নাটকীয়তা। সমাবেশস্থল হিসেবে শুরুতে কমলাপুর ও মিরপুর বাঙলা কলেজ মাঠের কথা জানানো হয়। পরে সায়েদাবাদসংলগ্ন গোলাপবাগ মাঠ জনসভার জন্য চূড়ান্ত হয়।
জনসভার দিন সকালে নগরীর বিভিন্ন মোড়ে কর্মজীবী মানুষদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। হঠাৎ হঠাৎ আসা বাসে সবাই উঠতে পারেনি। কারণ একেক বাস একেক রুটে। কিন্তু সবার গন্তব্য এক নয়।
মোড়ে মোড়ে পুলিশের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ছোট ছোট মিছিলও দেখা গেছে।
বাস কম কেন, এমন প্রশ্নে এক পরিবহন শ্রমিক বলেছেন, ‘মালিক চালাইতে না করছেন, তাই রাস্তায় বাস নামাই নাই।’
অফিসে যেতে যমুনা ফিচার পার্ক থেকে বিশ্বরোড পর্যন্ত হেঁটে এসেছেন এক চাকরীজীবী আয়নাল রহমান বাপ্পী। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আধাঘণ্টার বেশি দাঁড়ানোর পর মনজিল পরিবহনের একটি বাস পেয়েছি। এর মধ্যে কোনো বাস চোখে পড়েনি। কয়েকটা সিএনজি অটোরিকশা ছিল। ওনারা মিরপুরের দিকে যাচ্ছে। পাঠাওয়ের বাইক ছিল না।’
রাজধানীর গোলাপবাগে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের মঞ্চে নেতা-কর্মীরা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস/নিউজবাংলা
বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করেই নগরীতে এই বাস সংকট বলে মনে করেন এই যাত্রী। বলেন, ‘শুধু আমি না। সবাই তাই মনে করছে।’
মনজিল পরিবহনে চালকের সহকারী খোরশেদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাস চলাচল নিষেধ।’
কে নিষেধ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মহাজনে নিষেধ করেছেন।’
আপনি বাস চালাইছেন যে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কামারপাড়া স্ট্যান্ডে গিয়া পুলিশ আমগো কইছে যাত্রী চিল্লাচিল্লি করতেছে। তোরা একটা বাস নামা, পরে নামাইছি। পুলিশ দু-তিনজন আইয়া কইছে, পরে ছাড়ছি। নাইলে আমরা জীবনেও বাইরাইতাম না। আমার জীবনের ভয় আছে না?’
সাভারের জামগড়া থেকে ঢাকার গুলিস্তানে আসতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাককে। তিনি বলেন, ‘সকাল ৭টায় এসে আবদুল্লাহপুরে দেড় ঘণ্টা দাঁড়াইছিলাম। কোনো বাস নাই। দু-একটা এলেও পুলিশ দাবড়ানি দেয়।’
দূরপাল্লার বাস একেবারেই চলছে না। সকালে রাজধানীর মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে বহু দুর্ভোগ শেষে পৌঁছে আক্কেলগুরুম হয় যাত্রীদের। কাউন্টার বন্ধ, বাস কখন ছাড়বে- এসব বিষয়ে কেউ কিছু বলছে না।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবুল কাশেম বলেন, ‘জরুরি ভিত্তিতে ময়মনসিংহ যাওয়া দরকার এবং পত্রিকায় দেখেছি গাড়ি চলবে। এ জন্য সকালে বাস টার্মিনালে আসি। কিন্তু এখন দেখছি সব কাউন্টার বন্ধ রয়েছে।’
শ্যামলী বাংলা বাস কাউন্টারের এক কর্মী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকালে আমরা আমাদের গাড়ি সিরিয়ালে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে তা বন্ধ করতে হয়েছে।’
মহাখালী বাস টার্মিনালের সভাপতি আবুল কালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাস বন্ধের কোনো ঘোষণা নেই। যাত্রী নেই তাই বাস চলতে পারছে না। যাত্রী না থাকলে আমরা বাস কীভাবে চালাব?’