সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করে দেবে আর সবাই তা বসে বসে দেখবে, এমনটা কোনোভাবে সম্ভব নয় বলে মনে করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এজন্য দেশের সবাইকে সক্রিয় ভূমিকার রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।’
পাশাপাশি দুদককে সতর্ক করে রাষ্ট্রপতি বলেছেন, সর্ষের মধ্যে ভূত থাকতে পারবে না।
তা না হলে দুদকের প্রতি জনগণ আস্থা হারাবে বলে মনে করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ দিবসে শুক্রবার সকালে জাতীয় শিল্পকলা একাডেমিতে দুদকের এক অনুষ্ঠানে পাঠানো ভিডিও বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘সরকার বা দুদক সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করে দেবে আর আমরা বসে বসে দেখব বাস্তবে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দুর্নীতি দূর করতে হলে ধনী-দরিদ্র, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সবাইকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোরদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।’
ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে অসম্মানের চোখে দেখতে হবে জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দুর্নীতি আর উন্নয়ন একসঙ্গে চলতে পারে না। দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ টেকসই ও গুণগত মানসম্পন্ন উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে আর দুর্নীতি একে বাধাগ্রস্ত করে।’
রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, ‘সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে আমি কমিশনের সব পর্যায়ের কর্মচারীদের অনুরোধ করব, দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে তারা যেন সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা ও নৈতিকতা প্রদর্শন করেন। সর্ষের মধ্যে যেন ভূত না থাকে। অন্যথায় দুদক জনগণের আস্থা হারাবে।’
বিশ্বায়নের যুগে প্রযু্ক্তিগত উৎকর্ষের কারণে দুর্নীতিবাজদের কৌশলও বদলেছে বলে জানান রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি বলেন, ‘তাদের আইনের আওতায় আনতে হলে দুদককে আরও কৌশলী হতে হবে, প্রশিক্ষিত ও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ দিবসে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজরা যে দলেরই হোক দুর্নীতি করলে তাকে আইনের আওতায় শাস্তি পেতে হবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।’
দুদককে কার্যকর ও সাহসী পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, ‘ছোটো-বড়ো, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবার বেলায় একই পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষমতা দেয়া হয় দায়িত্ব পালনের জন্য, দেখানোর জন্য নয়। তাই দুদকের সব কর্মচারীকে ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হয় সমাজে এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধকে বেগবান করতে কমিশনকে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির অভিভাবক।
রাষ্ট্রপতি বলেন, “কমিশনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম যেমন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সততা স্টোর ও সততা সংঘ’ গঠন এবং মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি দুর্নীতি দমনে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।”
দুর্নীতি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটিকে বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেন রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করে, অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।’
মানুষের মাঝে দুর্নীতিবিরোধী চেতনা তৈরি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের মধ্য দিয়ে দুর্নীতিকে কমিয়ে আনা সম্ভব বলেও মনে করেন আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। একটা সময় ছিল ঘুষখোর, সুদখোর ও দুর্নীতিবাজদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল না বললেই চলে। কিন্তু কালের বিবর্তনে যেন সেই মূল্যবোধ ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে।
‘শহর, নগর ও গ্রামগঞ্জ সবখানেই যেন টাকাওয়ালাদের জয়জয়কার। টাকা কীভাবে এলো, সৎপথে না অসৎপথে এসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠিই যেন হয়ে গেছে টাকার দৌরাত্ম্য। তাই রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক সবাই কেবল টাকার পেছনে দৌড়াচ্ছে। টাকা কীভাবে আসছে বা সঠিক ও সৎ পথে আসছে কী না এসব নিয়ে ভাববার কোনো ফুরসত নেই। সামাজিক-অবক্ষয় ও মানবিক মূল্যবোধ এবং মানুষের নীতি-নৈতিকতার জন্য এ অবস্থা অশনি সংকেত।’