নয়াপল্টনে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের ঘটনায় গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার অভিযোগ, মিডিয়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের দেখালেও রাস্তায় আহত পুলিশের ছবি দেখায়নি। গাড়ি পোড়ানোর ছবি দেখায়নি।
আগামী শনিবার রাজধানীতে বিএনপির ডাকা বিভাগীয় সমাবেশের স্থান নিয়ে বিরোধের মধ্যে বুধবার এই সংঘর্ষের পরদিন দলীয় কার্যালয়ে এক আলোচনায় বক্তব্য রাখছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা।
গুলিস্তানের সেই কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের সঙ্গে যৌথ সভায় অংশ নেন কাদের।
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘বিএনপি আবার আগুন সন্ত্রাস শুরু করে দিয়েছে। ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে তারা জঙ্গিদের মাঠে নামিয়েছে। গত বুধবার পুলিশের ওপর হামলা করেছে। কিন্তু গণমাধ্যমের একটি অংশ এসব তুলে না ধরে পুলিশের হামলার কথা বলেছে।
‘বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিআরটিসি বাস পুড়িয়েছে। তারা পুলিশের ওপর হামলা করেছে। পুলিশ রাস্তায় পড়ে ছিল। সেই ছবি মিডিয়া দেখায়নি।’
কাদের বলেন, ‘তারা সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে ফেলবে, সেই ছবি মিডিয়া দেখাবে না, এই দুর্ব্যবহার কেন করা হচ্ছে? মিডিয়ার একটি অংশ কেন একটি পক্ষ নিচ্ছে? এটা আমার অভিযোগ।’
সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় বিএনপিকেই দায় দেন কাদের। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ আতঙ্কে আছে। বিএনপি লাশ ফেলার দুরভিসন্ধি গতকাল কার্যকর করেছে।’
সেদিনের সেই ঘটনায় কেবল নয়, ওবায়দুল কাদেরের অভিযোগ, মিডিয়ার পক্ষপাতের প্রমাণ মিলেছে কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রীর জনসভার ক্ষেত্রেও।
তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারে এত বড় সমাবেশ, মিডিয়া ঠিকভাবে দেখায়নি।… মিডিয়ার কাছে আমরা প্রত্যাশা করি, তারা যা দেখবে তাই দেখাবে। আমরা সত্যকে তুলে ধরার আহ্বান জানাই।’
সড়কে কোনো সমাবেশ নয়
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, তারা রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করবেন না। আগামীকাল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সমাবেশ মহানগর নাট্যমঞ্চে হবে। জনগণের ভোগান্তি দেয়া যাবে না।
দলের নেতা-কর্মীদের সতর্ক পাহারায় থেকে সতর্ক থাকার তাগিদ দেন তিনি। বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সব বিভাগ, জেলা, উপজেলা, থানা, ওয়ার্ডে সতর্ক অবস্থায় থাকবে। আক্রমণ আমরা করব না, তবে আক্রান্ত হলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে। আমরা সরকারি দল, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আমাদের যেন আক্রমণকারী বদনাম না হয়।’
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত ১২ অক্টোবর থেকে বিএনপি ধারাবাহিকভাবে বিভাগীয় শহরগুলোতে যে সমাবেশ করছে, তার অংশ হিসেবে আগামী শনিবার ঢাকায় জমায়েতের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে এই জনসভার স্থল নিয়ে তৈরি হয়েছে বিরোধ। বিএনপি সমাবেশটি করতে চায় নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে। তবে পুলিশ অনুমতি দিয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখানে যেতে আপত্তি আছে দলটির।
বিএনপির পক্ষ থেকে এরপর মৌখিকভাবে আরামবাগে সমাবেশ করতে চেয়েছিল, তবে তাদের মৌখিকভাবেই সেই আবেদন নাকচ করেছে।
এরপর পুলিশের অনুমতি ছাড়াই সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়ার পর বিএনপির নেতা-কর্মীরা মঙ্গলবার রাত থেকেই নয়াপল্টনে জড়ো হতে থাকেন। বুধবার সকাল থেকে দুটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে চলছিল বক্তৃতাপর্ব, আর দুপুরের পর সামনের সড়কে জড়ো হতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেই শুরু হয় সংঘর্ষ।
ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল, কাঁদানে গ্যাস আর রাবার বুলেটে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এলাকাটি। মৃত্যু হয় একজনের। পরে বিএনপি কার্যালয়ে হানা দিয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আটক করা হয় ১০ ডিসেম্বর থেকে বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে দেশ চালানোর ঘোষণা দেয়া আমান উল্লাহ আমান ও শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিকেও। দিন শেষে আটকের সংখ্যটি ছড়ায় ৩০০।
বিএনপি কার্যালয় থেকে জব্দ করা হয় ১৭০ বস্তা চালসহ রান্নার উপকরণ এবং কয়েক ডেকচি রান্না করা খিচুড়ি। ২৫ থেকে ৩০টি ককটেল উদ্ধার করে সেগুলো নিরাপদে বিস্ফোরণ করার কথাও জানানো হয়।
পুলিশ বলছে, অনুমতি ছাড়াই বিএনপি সেখানে সমাবেশের চেষ্টা করছিল। তবে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বিএনপিকে সতর্ক করে বলেছেন, বিএনপি নয়াপল্টনে সমাবেশ করার চেষ্টা করলে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবেন তারা। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেলে তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তার।
কূটনীতিকদের বক্তব্যে ক্ষোভ
বাংলাদেশের সবার অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে পশ্চিমা ১৫টি দেশের কূটনীতিকদের যে বিবৃতি সেটির বিষয়েও প্রতিক্রিয়া জানান কাদের। তার অভিযোগ, এই আহ্বান একতরফা এবং কূটনীতির শিষ্টাচারের বিরোধী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের বিদেশি বন্ধুরা একতরফা কথা বলবে, এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়।’
মঙ্গলবার রাতে একটি যৌথ বিবৃতিতে ১৫টি দেশের কূটনৈতিকরা বলেন, ‘বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে আমরা বাংলাদেশের সাফল্যকে আরও উৎসাহিত করতে আগ্রহী। আমরা মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশন, ব্রিটিশ হাইকমিশন, কানাডিয়ান হাইকমিশন, ফরাসি দূতাবাস, জার্মান দূতাবাস, জাপান দূতাবাস, ডেনমার্ক দূতাবাস, ইতালির দূতাবাস, নেদারল্যান্ডসের দূতাবাস, নরওয়ের দূতাবাস, স্পেনের দূতাবাস, সুইডিশ দূতাবাস, সুইজারল্যান্ডের দূতাবাস ও অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন যৌথভাবে এই বিবৃতি দিয়েছে।
কাদের বলেন, ‘বিএনপি নেতাদের কাছে লন্ডন থেকে ফরমায়েশ আসে। মির্জা ফখরুল চাকরি রক্ষার জন্য তা করে। ষড়যন্ত্রের চোরাগলি দিয়ে বিএনপি সরকার হটানোর চেষ্টা করছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে আমরা দেশকে তুলে দিতে পারি না, এটা আমাদের শপথ।’
বিশ্ব সংকটময় পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা শক্ত হাতে দেশের হাল ধরেছেন বলেও দাবি করেন কাদের। তিনি বলেন, ‘সে কারণেই বৈশ্বিক সংকট এ দেশে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিদ্যুতের সমস্যা নিয়ে এমন কোনো অভিযোগও নেই।’