নয়াপল্টনে শনিবারের সমাবেশ করার অনুমতি না দিলে বিকল্প ও গ্রহণযোগ্য জায়গার প্রস্তাব আওয়ামী লীগ বা সরকারকে দিতে হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, যদি বিকল্প জায়গার প্রস্তাব করা না হয়, তাহলে নয়াপল্টনেই সমাবেশ হবে।
রাজধানীতে সমাবেশ করার মতো ফাঁকা জায়গাগুলো আওয়ামী লীগ সরকারই বন্ধ করেছে জানিয়ে দলটির সংবাদ সম্মেলনে এ-ও বলা হয়েছে যে ক্ষমতাসীন দল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো বন্ধ করতে চায়।
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দবিতে গত ১২ অক্টোবর থেকে বিএনপি বিভাগীয় শহরগুলোতে যে সমাবেশ করে আসছে, তার ধারাবাহিকতায় ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে যে সমাবেশ ডাকা হয়েছে, সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে ভেন্যু জটিলতায়।
বিএনপি নয়াপল্টনে এই সমাবেশ করতে চায়, কিন্তু সড়কে সমাবেশ করতে দিতে নারাজ সরকার। পুলিশ অনুমতি দিয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, তবে সেখানে যেতে চায় না বিরোধী দলটি। তারা নয়াপল্টনের বিকল্প হিসেবে আরামবাগ চাইলেও সেটিও কার্যত নাকচ করে দেয়া হয়েছে।
সমাবেশের তিন দিন বাকি থাকতে বিএনপি যে প্রচার চালাচ্ছে, সেই লিফলেটে সমাবেশস্থলের নামও উল্লেখ নেই।
এই অবস্থায় দলের পক্ষ থেকে বুধবার নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘যদি সরকার মনে করে আমাদের (সমাবেশ) করতে দেবে না, আমরা আমাদের কর্মীদের বলেছি, আমাদের সমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ। এটা কোনো রকম লগি-বৈঠার মিটিং নয়, এটা কোনো মানুষ হত্যার মিটিং নয়, এটা কোনো অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার মিটিং নয়। এটা হলো একটা শান্তিপূর্ণ মিটিং, জনগণের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে, জনগণের পেটে ভাতের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই সমাবেশ।
‘বাধার সৃষ্টি করলে যদি কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে সরকার দায়ী থাকবে, এ কথা আমরা পরিষ্কার বলে দিতে চাই।’
এই সংবাদ সম্মেলনগুলো সাধারণত দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী করে থাকেন। তবে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় তিনি এখন আত্মগোপনে।
আব্বাস বলেন, ‘আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, বিকল্প প্রস্তাব আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে। গ্রহণযোগ্য এবং বিকল্প প্রস্তাব আওয়ামী লীগ অথবা সরকারকেই দিতে হবে। অথবা আমাদের প্রস্তাবকে মেনে নিতে হবে, আমরা সভা করব।
‘আমাদের কার্যক্রম চলছে, আমাদের কার্যক্রম চলবে, এটা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। ঢাকায় সমাবেশ আমরা করব।'
সরকার যদি বিকল্প আর কোনো প্রস্তাব না দেয় তাহলে কী হবে- এমন প্রশ্নে আব্বাস বলেন, ‘যদি গ্রহণযোগ্য পছন্দনীয় জায়গা বের না করে তাহলে পল্টনই আমাদের পছন্দের জায়গা। পল্টনেই হবে সমাবেশ।’
পুলিশ বাধা দিলে কী হবে, জানতে চাইলে জবাব আসে, ‘পুলিশের কাজ পুলিশ করবে, আমাদের কাজ আমরা করব।
‘তবে পুলিশ যেন দলীয় না হয়ে যায়, পুলিশ যেন কোনো দলের হাতিয়ার না হয়ে যায়। তাদেরকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চাকরি করেন, আওয়ামী লীগের চাকরি তারা করে না।’
নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ। ফাইল ছবি
বিশৃঙ্খলা হলে দায় আওয়ামী লীগের
বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে নয়াপল্টনে বোমাবাজির শঙ্কা নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনেরও সমালোচনা করেন আব্বাস।
তিনি বলেন, ‘আজকের পত্রিকায় এসেছে, বিএনপি-জামায়াত বোমাবাজি করবে। আচ্ছা পৃথিবীর কোনো বিবেকবান মানুষ কী বলবে, আমার সভা আমরা করব, শান্তিপূর্ণ সভা করব, গত তিন মাস ধরে সভা করছি, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছি, কোনো ঝামেলা হয়নি, এখন আমরা বোমাবাজি করব?
‘আমরা বলতে চাই, যদি কোনো ধরনের ঘটনা ঘটে, এর জন্য সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগ দায়ী হবে। এটা আওয়ামী লীগ করছে। বোমাবাজির ঘটনা সৃষ্টি করছে, জন্ম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখনও তারা সভা-সমাবেশ নষ্ট করার জন্য একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে।’
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমাদের কর্মসূচি হবে শান্তিপূর্ণ। গণসমাবেশ ঘিরে একটি রিকশার টায়ার বার্স্ট হলেও দায় সরকারের।’
‘সড়কে সমাবেশ কেউ করতে না পারলে বিএনপিও করবে না’
এই অবস্থায় দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে এসে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, পুলিশ যদি বলে কোনো দল সড়কে সমাবেশ করতে পারবে না, তাহলে তারা মেনে নেবেন। তবে আপাতত তাদের সমাবেশ নয়াপল্টনেই হবে।
তিনি বলেন, ‘বিএনপি সমাবেশ করলে সরকারের বক্তব্য হলো এটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে। ছাত্রলীগের লোকেরা যখন মিটিং করে, তখন পুলিশ বলে দিচ্ছে এই রাস্তা থেকে এই রাস্তা, এই রাস্তা থেকে এই রাস্তা বন্ধ থাকবে। সেখানে কোনো রকম ঝামেলা হয় না।
‘আমরাও এ রকম চাই। আমরা যখন নয়াপল্টনে মিটিং করব, তখন পুলিশ দয়া করে কিছু রাস্তা, যেখান দিয়ে পাবলিক চলাচল করতে পারবে সেটা বলে দিক। বলে দিক, আপনারা এই রাস্তায় চলাচল করবেন, এই রাস্তা বন্ধ থাকবে। আইন সবার জন্য সমান হওয়া উচিত।
‘কিন্তু তারা সেটা না করে বিএনপির বেলায় করে এক রকম, আওয়ামী লীগের বেলায় করে আরেক রকম। ছাত্রলীগের বেলায় করে এক রকম, ছাত্রদলের বেলায় করে আরেক রকম। এমন তো হতে দেয়া যায় না।’
বিএনপি নেতা বলেন, ‘এমন যদি করা হয় যে, কেউ রাস্তায় মিটিং করতে পারবে না, আমরা এক শ ভাগ মেনে নেব। তবে সেই নিয়ম সবার জন্য হতে হবে। আপাতত আমরা আমাদের সমাবেশের জন্য যে আবেদন করেছি, সে আবেদনের স্থানটা ঠিক আছে। আমরা সেখানেই সমাবেশ করব।’
পছন্দের জায়গা নয়াপল্টন না পেলেআরামবাগ যেতে চায় বিএনপি। ছবি: নিউজবাংলা
মাঠ তো আ.লীগই বন্ধ করেছে
সমাবেশের মাঠ হিসেবে ব্যবহার হতো, এমন ফাঁকা জায়গাগুলো আওয়ামী লীগের আমলেই বন্ধ হয়েছে বলেও জানান মির্জা আব্বাস।
পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাদের আলোচনার বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘অনেক নতুন নতুন কর্মকর্তা হয়েছে তো, ঢাকায় কোথায় কোথায় মাঠ আছে, কোথায় কোথায় মাঠ ছিল, এটা তারা জানে না। কোথায় কোথায় সভা করতে হবে, এটা তারা জানে না। আমাদের এমন এমন সব জায়গার কথা বলছে, যেখানে এক সময় মাঠ ছিল, এখন নাই।
‘উত্তরার কথা বলে, ওখানে তো মাঠই নেই এখন, মার্কেট হয়ে গেছে। ফুলবাড়ীয়াতে মাঠ ছিল, আমরা সেখানে মিটিং করেছি, এখন তো মাঠ নেই, মার্কেট হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগই তো করেছে, আমরা তো করি নাই।’
আব্বাস বলেন, ‘জনসভা করার, কথা বলার যে অধিকারগুলো আছে, আছে সেটাকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য সকল মাঠ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান, মুক্তাঙ্গন... ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে আমি ভাসানীর সভা দেখেছি, মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের সভা দেখেছি। এখানে আমাদের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সভা দেখেছি, বহু সভা দেখেছি ছোটবেলা থেকে। বাবার সঙ্গে গিয়েছি মিটিংগুলোতে। এখন সেখানে সভা করার জায়গা নাই, আউটার স্টেডিয়াম করে ফেলেছেন।’
বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনের গলিটি ২০টা বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি নেতা বলেন, ‘জনগণের অসুবিধা হয় না? আমরা যখন ছোট ছিলাম, গুলিস্তান মার্কেটে যেতাম শপিং করার জন্য। সেখানে ৩২টি মার্কেট, রাস্তা বন্ধ। তারা যা খুশি করবে, তাই বলব, দেশটা জনগণের, কারও পৈতৃক নয়।’
‘আমাদের মতো ঘুমাতে পারছে না আ.লীগের নেতা-কর্মীরাও’
বিএনপির সমাবেশকে সামনে রেখে পুলিশ দলের নেতা-কর্মীদের হয়রানি করছে বলেও অভিযোগ করেন আব্বাস। বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা ঘুমাতে পারছে না বাসায় পুলিশের ভয়ে আতঙ্কে।
‘তারা সরকারের পেটোয়া বাহিনী, প্রাতিষ্ঠানিক বাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে নেতা-কর্মীদের হয়রানি করছে, তারা বাসায় থাকতে পারছে না, পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
‘প্রতিদিন আমাদের নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছে। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ নেতৃবৃন্দ কোর্ট থেকে এসেছেন। সেখানে আমাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কোর্টে প্রডিউস করা হয়েছে। বিনা অপরাধে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কোনো কারণ নেই।’
তবে ভয় আওয়ামী লীগের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, এটি তাদের আন্দোলনের সার্থকতা।
সরকার চায় বিএনপি সমাবেশ করুক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তবে বিএনপি এখন পর্যন্ত রাজি নয় এতে। ছবি: নিউজবাংলা
‘আমাদের ছয় কম কর্মীকে গুলি করে হত্যা করেছে। আজকে একই রকম মিটিং করছি এবং লক্ষ্য করছি সরকার অহেতুক কেমন যেন একটা আতঙ্কিত অবস্থায় আছে। ... আওয়ামী লীগ রাতে ঘুমাতে পারছে না তাদের বাসায় ক্ষমতা চলে যাবে এই আতঙ্কে। এটা হলো আমাদের সার্থকতা। আমাদের সার্থকতা এখানেই যে তাদেরকেও আমরা নির্ঘুম করে দিতে পেরেছি। অনেক টেনশনে তারা আছে’-বলেন বিএনপি নেতা।
এই বাধা বিপত্তি ভীতি উপেক্ষা করেও বিএনপির নেতা-কর্মীরা সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে মির্জা আব্বাস তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান। বলেন, ‘এটা তাদের দেশপ্রেমের একটা নিদর্শন।’
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, সদস্যসচিব আমিনুল হক, ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।