বর্তমান বিশ্বে এক দেশ থেকে আরেক দেশ ভ্রমণে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয় আকাশপথকে। সরকারি হিসাবে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস করছেন। দেশের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে তাদের একটি বড় অংশই নিয়মিত আকাশপথে যাতায়াত করেন।
১৯৯৬ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে সদস্য দেশগুলোকে প্রতি বছরের ৭ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল দিবস পালন করতে বলা হয়। সেই থেকে দিনটি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল দিবস হিসেবে পালন হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিই ছিল দেশের একমাত্র বিমান পরিবহন সংস্থা। এরপর অবশ্য বিভিন্ন সময়ে ১১টি বেসরকারি এয়ারলাইনসকে যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দিয়েছে সরকার, তবে এদের ৯টিই শেষ পর্যন্ত উড়ানে থাকতে পারেনি। একে একে আন্তর্জাতিক উড়ানে থাকার পরও বন্ধ হয়ে গেছে জিএমজি এয়ারলাইনস, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রিজেন্ট এয়ার।
দেশে বর্তমানে বিমান ছাড়াও বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস-বাংলা আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আরেক বেসরকারি এয়ারলাইনস নভো এয়ার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের পাশাপাশি বিদেশে একটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
অন্যদিকে দেশে বর্তমানে ৩০টিরও বেশি-বিদেশি এয়ারলাইনস সক্রিয়। দেশের এভিয়েশন বাজারের ৮০ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে এসব এয়ারলাইনস। এর মধ্যে রয়েছে এমিরেটস, কাতার এয়ার, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, ওমান এয়ার, এয়ার এশিয়া, মালয়েশিয়ান এয়ার, টার্কিশ এয়ার ইত্যাদি।
এর মধ্যে এমিরেটস, কাতার এয়ার, সিঙ্গাপুর এয়ারের শুরুটা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানের সাথেই। কিন্তু এই ৫০ বছরে এই সংস্থাগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে কয়েক গুণ, যার ধারেকাছেও নেই বিমান।
স্বাধীনতার সুদীর্ঘ ৫০ বছরেও দেশের এভিয়েশন বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশি এয়ারলাইনসগুলোর ব্যর্থতায় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা হাতছাড়া হচ্ছে বাংলাদেশের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এভিয়েশনবান্ধব নীতি গড়ে না ওঠায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহেদুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মার্কেট ডমিনেশনের মূল কাজটি করে থাকে ন্যাশনাল ক্যারিয়ার। আমাদের এখানে একসময় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাজার বিমান একাই নিয়ন্ত্রণ করত, কিন্তু এখন সেই বাজার কমতে কমতে বিশের নিচে নেমে এসেছে। এই সময় দেশে-বিদেশি এয়ারলাইনস বেড়েছে, তাদের ফ্লাইট সংখ্যাও বেড়েছে। বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো যেভাবে এগিয়েছে বিমান সেভাবে পারেনি।
‘প্রাইভেট এয়ারলাইনস যারা এসেছে, তাদের অনেকগুলোই আর ব্যবসায় থাকতে পারেনি। এখন যারা আছে ইউএস- বাংলা এবং নভো, তাদের কারও বয়সই ১০ বছর হয়নি। তাদের গ্রোথ হতে সময় লাগবে। তারা এখনও শুরুর স্টেজে আছে। দেশি এয়ারলাইনসকে এগিয়ে নিতে যে ধরনের নীতি সহযোগিতা সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন, যেমন ফুয়েলের দাম, ট্যাক্স স্ট্রাকচার, সারচার্জ সেগুলোও নেই। ফলে স্থানীয় এয়ারলাইনসগুলোও সুবিধা করতে পারছে না; নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে। এখানে এভিয়েশন ফ্রেন্ডলি পলিসি না হওয়াটা একটি বড় কারণ। এগুলো পেরিয়ে দেশি এয়ারলাইনসগুলোর এগিয়ে যাওয়া কঠিন। সরকার সহযোগিতা না করলে এরা বেশি দূর যেতেও পারবে না।’
বর্তমানে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এয়ার সার্ভিস অ্যাগ্রিমেন্ট বা ফ্লাইট চলাচল চুক্তি রয়েছে। অর্থাৎ এ দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরাসরি আকাশপথে যুক্ত হতে পারে, তবে সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না দেশি এয়ারলাইনসগুলো।
বাংলাদেশি এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমান বর্তমানে ১৩টি, ইউএস-বাংলা ৯টি এবং নভোএয়ার একটি দেশে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
বিমানের বহরে বর্তমানে রয়েছে ২১টি উড়োজাহাজ। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ট্রিপল সেভেন, ছয়টি বোয়িং সেভেন এইট সেভেন ড্রিমলাইনার, ছয়টি বোয়িং সেভেন থ্রি সেভেন এবং পাঁচটি ড্যাশ এইট মডেলের উড়োজাহাজ। অন্যদিকে ইউএস- বাংলার বহরে রয়েছে ১৭টি উড়োজাহাজ।
ইউএস-বাংলা এয়ালাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত ২০ বছর আগে আমাদের যতগুলো আন্তর্জাতিক গন্তব্য ছিল, আমরা এখনও সেগুলোকেই ছুঁতে পারিনি। এভিয়েশন খাতে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের যে অপারেটিং কস্ট, যেমন জেট ফুয়েলের দাম, বেবিচকের অ্যারোনটিক্যাল ও নন অ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলো যদি লজিক্যাল অ্যামাউন্টে নির্ধারণ করা হয়, সে ক্ষেত্রে আমরাও এগিয়ে যেতে পারব বা বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যেতে পারব।
‘এই খাতকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাদের জাতীয় আয়ে যেমন ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, তেমনি বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে, সেটিও আমরা সাশ্রয় করতে পারব। এ ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা লাগবে।’