বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যে গ্রামে সবাই বানায় কুমড়ো বড়ি

  •    
  • ৭ ডিসেম্বর, ২০২২ ১০:৪৫

বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার সাবলা গ্রামের প্রায় সবার কয়েক পুরুষের পেশা কুমড়োর বড়ি বানানো। এক সময় পরিবারের প্রয়োজনে এগুলো বানানো হতো। এখন এটি সাবলা গ্রামের মানুষদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। কারিগরদের তথ্যমতে, সাবলা গ্রামে প্রতি মাসে অন্তত ৩৫ লাখ টাকার কুমড়ো বড়ি বিক্রি হয়।

ব্রজেন চন্দ্র মোহন্তের বয়স এখন চলছে ৬৫। প্রতি বছর থেকে শীত এলেই তৈরি করেন কুমড়ো বড়ি। এর আগে তৈরি করেছেন তার বাবা-দাদা। এই বড়ি কারিগর বলেন, ‘শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমরা কুমড়ো বড়ি তৈরি করি। এটা আমাদের বাপ-দাদার পেশা।’

বগুড়ার দুপচাঁচিয়ার সাবলা গ্রামের প্রায় সবার কয়েক পুরুষের পেশা এটি। এক সময় পরিবারের প্রয়োজনে এগুলো বানানো হতো। এখন এটি সাবলা গ্রামের মানুষদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে।

কারিগরদের তথ্যমতে, সাবলা গ্রামে প্রতি মাসে অন্তত ৩৫ লাখ টাকার কুমড়ো বড়ি বিক্রি হয়।

কুমড়ো বড়ি উত্তরাঞ্চলের মানুষের জনপ্রিয় খাবার। মাষকলাই ও চাল কুমড়া দিয়ে তৈরি হয় কুমড়ো বড়ি। মূলত শীতকালেই এটি তৈরি ও খাওয়ার চল বেশি।

সাবলা গ্রামের ব্রজেন চন্দ্র বলেন, ‘এ গ্রামে প্রায় ৬৫ ঘর কুমড়ো বড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত। প্রত্যেক বাড়ি প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ কেজি বড়ি তৈরি করে। আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বড়ি তৈরি। চলে চৈত্র মাস পর্যন্ত। আমরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এই বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে থাকি।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখন ৫ কেজি মাষকালাইয়ের দাম ১৫ টাকা ছিল, তখন থেকে আমি বড়ি তৈরি করছি। আমি যেমন বাবার হাত ধরে এ পেশায় এসেছি। আমাদের সন্তানেরাও তেমনি কুমড়ো বড়ি তৈরির হাল ধরবে।’

বগুড়া শহর থেকে পশ্চিমে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে নাগর নদের তীরে অবস্থিত সাবলা গ্রাম। গ্রামের অধিকাংশ নারী-পুরুষ সনাতন ধর্মের। শীতকালের সময়টায় গ্রামের প্রবেশমুখ থেকেই চোখে পড়ে চাটাইয়ের ওপর সারি করে বিছানো সাদা মাষকলাইয়ের তৈরি কুমড়া বড়ি। গ্রামের ভিতরে গৃহিণীরা বাড়ির ছাদে একত্রে দল বেঁধে বা কেউ কেউ মাটিতে মাদুর পেতে বড়ি তৈরির কাজ করছেন।

এ কাজে নারীদের হাতের ছোঁয়াই বেশি। তবে বাড়ির পুরুষদের ভূমিকা কম নয়। তারা যাতায় কালাই পেষেন। বড়িও বানান। তাদের সাথে হাত মিলিয়ে ছোটরাও শিখে নেয় বড়ি তৈরি। অনেকের বাড়িতে মেশিনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে কুমড়ো বড়ি।

বড়ি তৈরির প্রক্রিয়া জানান সাবলা গ্রামের গৃহবধূ পপি মোহন্ত। শীতের এই মৌসুমে প্রতিদিন রাত ২টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত তারা বড়ি বানানোর কাজ করেন।

পপি মোহন্ত জানান, প্রথমে মাসকলাই রৌদ্রে শুকিয়ে যাতায় ভেঙ্গে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হয়। পরে প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা মাষকলাই পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। ঢেঁকি বা শিল-পাটায় কুমড়ো বেটে নিয়ে মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর কলাই ও চাল কুমড়া দুইটির মিশ্রণে বানানো হয় বড়ির উপকরণ।

এরপর বড়িগুলো পাতলা কাপড়ে সারি করে বাঁশের মাচাঙে রেখে রোদে শুকানো হয়। এতে সময় লাগে অন্তত তিন দিন। অনেকে বড়িকে শক্ত করার জন্য অল্প পরিমাণে আলো চালের আটা মেশায়।

গ্রামের আরেক নারী কারিগর শ্রীমতি পুর্নিমা মোহন্ত। তার বাড়ি শেরপুর উপজেলার মির্জাপুরে। কিন্তু প্রায় আট বছর আগে সাবলা গ্রামে বিয়ের সুবাদে কুমড়ো বড়ি তৈরি করা শেখেন। জানালেন, দৈনিক ১০ থেকে ১২ কেজি কুমড়ো বড়ি তৈরি করতে পারেন তারা।

অন্য সব ব্যবসার মতো এতেও জিনিসপত্রের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে বলে জানান পুর্নিমার স্বামী রামকৃষ্ণ মোহন্ত। গত মৌসুমে প্রায় আড়াই লাখ টাকার বড়ি বিক্রয় করেছিলেন তিনি। রামকৃষ্ণ জানান, গত বছর ৫০ কেজির মাষকলাইয়ের বস্তার দাম ছিল ৩ হাজার ৮০০ টাকা। এ বছর তিনি তা কিনেছেন ৫ হাজার ৬০০ টাকায়। এ কারণে এবার কুমড়ো বড়ির দাম বাড়ানো হয়েছে।

কারিগররা জানান, প্রত্যেক ঘরে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ কেজি কমুড়ো বড়ি তৈরি ও বিক্রি করে থাকেন তারা।

দুই ধরনের কুমড়ো বড়ি তৈরি হয়। একটি সাধারণ মানের। আর ভালোটি শুধু মাষকলাই দিয়ে তৈরি, দামও বেশি। সাধারণ বড়ি পাইকারি হারে প্রতি কেজি ১৫০ টাকায় এবং ভালোটি ২৫০ টাকা দরে বিক্রি করেন তারা। খুচরা হিসেবে ভালো মানেরটি সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়।

ঐতিহ্যের গ্রামের বাসিন্দারা কয়েক বছর আগেও বেশ অভাবে ছিলেন। কিন্তু এখন তাদের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

লাবনী রানী নামে এক কারিগর বলেন, ‘আমাদের আগে কাঁচা বাড়ি ছিল। চার বছর হলো বাড়ি পাকা করেছি। কুমড়ো বড়ি থেকে আয়ের টাকা জমিয়ে এই বাড়ি করেছি। শুধু আমার বাড়ি নয়, গ্রামের সবার বাড়িঘর উন্নত হয়েছে বড়ির ব্যবসা থেকে।’

নিজেদের জীবন মানের উন্নতির কথা বললেন আরেক ষাটোর্ধ কারিগর শ্যামল কুমার মোহন্ত। তিনি বলেন, ‘এ গ্রামের কুমড়োর বড়ি তৈরির ইতিহাস প্রায় একশ বছরের বেশি। এখানকার বড়ির চাহিদা দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে।’

শ্যামল আরও বলেন, ‘এখন এটি আর মৌসুমি ব্যবসা নয়। নিয়মিত ব্যবসা হয়ে উঠছে। ফলে এখানকার মানুষের জীবনমানও উন্নত হচ্ছে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ছে।’

কাহালুর বিবির পুকুর এলাকার পাইকারী ব্যবসায়ী মোজাফ্ফর হোসেন পাঁচ বছর ধরে কুমড়ো বড়ি ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে সাবলা গ্রাম থেকে ৩ মণ বড়ি কিনি। এখানকার বড়ির মান ভালো। প্রতি বছর আমার দোকানে প্রায় তিন লাখ টাকার কুমড়ো বড়ি বিক্রি হয়। এ ছাড়া নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, ঢাকার পাইকাররাও আসে এই সাবলা গ্রামে।’

এ বিভাগের আরো খবর