বরগুনায় মাদকের বিস্তৃতির বিষয়টি আলোচনায় এসেছিল ২০১৯ সালের জুনে রিফাত শরীফ হত্যার পর। সে সময় জানা যায়, মাদকের নিয়ন্ত্রণ আর মাদককে ঘিরে গড়ে ওঠা কিশোর অপরাধী চক্রের তথ্য।
সেই ঘটনার ঘটনার পর এবং করেনাকালীন বরগুনায় মাদকের বিস্তার কিছুটা কমলেও সম্প্রতি আবার উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামেও মাদক এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে।
গত শনিবার জেলা পুলিশের আয়োজনে মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক সভায় ফের মাদকের বিস্তৃতির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এই সভায় মাদকের বিস্তৃতি রোধে পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সমালোচনাও উঠে।
শহরে মাদকের বড় চালান ঢোকার পর চাহিদা অনুযায়ী বিক্রয় প্রতিনিধিদের কাছে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে কোনো বিক্রয় প্রতিনিধি ধরা পড়লেও অল্পসংখ্যক ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়ে। অল্পদিনেই আইনি প্রক্রিয়ায় কারাগার থেকে বের হয়ে আসতে পারন তারা। আর মাঠপর্যায়ে থাকা তদারককারী এবং নেপথ্যে থাকা মূল নিয়ন্ত্রকও নিরাপদে থাকেন। কারণ, বড় চালান ধরা পড়ার নজির কম।
মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তির তথ্য বলছে, জেলায় চিহ্নিত কিছু কারবারি ও ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন ব্যক্তির যোগসাজসে মাদকের কারবার চলছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে কেউ কেউ অর্থ লগ্নি করে ভাগ নিচ্ছেন।
মাদক ব্যবসা পরিচালনার জন্য ওয়ার্ড থেকে পাড়া-মহল্লায় ‘বিক্রয় প্রতিনিধি’ নিয়োগ দেয়ার তথ্যও মিলেছে। তাদের দেখভালের জন্য আছেন এলাকাভিত্তিক ‘বড় ভাই’। এই বড় ভাইয়েরাও আবার আরেক বড় ভাইয়ের লোক হিসেবে পরিচিত যারা মূলত মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
শহরের খাজুরতলা, লাকুরতলা, কালীবাড়ী সড়ক, ডিকেপি সড়ক ক্রোক, কাঠপট্টি, থানাপাড়া, বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড, বরগুনা স্টেডিয়া সংলগ্ন এলাকা, সোনাখালী, পিটিআই সড়ক, কলেজ ব্রাঞ্চ ও বটতলা, ধানসিঁড়ি সড়ক ও পশ্চিম বরগুনায় মাদক বিক্রি ও সেবন করতে দেখা যায়।
এসব এলাকায় ছোট ছোট উপদল ও তাদের দল নেতারা মাদকের খুচরা বিক্রেতা হিসেবে ব্যবসা পরিচালনা করেন। চাহিদা অনুযায়ী ইয়াবা সরবরাহ, অর্থ আদায় এবং টুকটাক ঝামেলা মেটানো সংঘবদ্ধ দলের কাজ।
শুধু শহরে নয় ছড়িয়েছে গ্রামে
উপজেলার সদরের হেউলিবুনিয়া ইউনিয়নের, এম বালিয়াতলী ইউয়িয়নের লাকুতলা মনসাতলী, পরীরখাল বাজার ও চালিতাতলী বাজার, বুড়িরচর ইউয়িনয়ের বড়লবনগোলা, গুলবুনিয়া, পুরাকাটা ফেরি ও লঞ্চঘাট, কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের কেওড়াবুনিয়া, আয়লা ও কদমতলা বাজার, ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী খেয়াঘাট, বরইতলা ফেরিঘাট, ডালভাঙা ও রায়ভোগ চৌমুহুনি বাজার, নলটোনা ইউনিয়নের বাবুগঞ্জ, গর্জনবুনিয়া ও নলটোনা খেয়াঘাটসহ ১০টি ইউনিয়নেরই হাটবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানে এখন হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় ইয়াবা ও গাঁজা।
গত শনিবার পুলিশের আয়োজনে সেই মাদকবিরোধী সভায় বরগুনা প্রেসক্লাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জাফর হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘আমরা বরগুনায় এক হাজার মাদক কারবারীর নাম দিতে পারি। পুলিশ যদি আমাদেরকে কথা দেন যে তারা আমাদেরকে নিরাপত্তা দেবেন, তাহলে আমরা তথ্য দেব।’
কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সাধারণ সম্পাদক মুশফিক আরিফ বলেন, ‘বরগুনার আখরাবাড়ি, কাঠপট্টিসহ বেশ কিছু স্থানে রমরমা মাদকের বিক্রি চলে। যখন কোনো মাদক কারবারি কিংবা মাদকাসক্তকে ধরা হয়, তখনই কোনো না কোনো নেতার ফোন পেয়ে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। এদের বিরুদ্বে আগে ব্যাবস্থা নিতে হবে।’
ওই অনুষ্ঠানে বরিশালের ডিআইজি এসএম আখতারুজ্জামান বলেন, ‘সকলের সহযোগিতা থাকলে মাদক নির্মূল সম্ভব। পুলিশকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করবেন। আপনাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়া হবে।’
বরগুনার পুলিশ সুপার আবদুস ছালাম বলেন, ‘বরগুনায় বড় ধরনের পাইকারি মাদক বিক্রেতা এখনও ধরা পড়েনি। আমাদের অভিযানে খুচরা বিক্রেতা ও সেবনকারীই ধরা পড়ে বেশি। মাদকের বিরুদ্ধে জেলা পুলিশ জিরো টলারেন্স অবস্থানে রয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করে আসছে। আমরা স্থানীয় নাগরিকদের সহায়তা নিয়ে মাদক নিমূল সম্ভব না হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করছি।’