জীবন ও জগতের নিগূঢ় তত্ত্বকে আঞ্চলিক শব্দের দ্যোতনায় সহজিয়া ভাষায় প্রকাশ করে অমর হয়ে আছেন মরমী সংগীত মহাজন দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী। আভিজাত্যের গৈরিক পোশাকের সঙ্গে পৈতৃক নাম দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী বদলে দিয়ে কেবল ‘হাসন রাজা’ নামেই তিনি সংগীতে মহান হয়ে আছেন। জমিদারি বাদ দিয়ে বৈরাগ্যের বেশে এ নাম নিয়েই সংগীত সাধনা করেছেন আমৃত্যু। তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় হাজারের অধিক।
আজ এই মরমী মহাজনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী। সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী পরগনায় ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর জন্ম নেয়া হাসন রাজা ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর মারা যান। হাসন রাজার শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে পারিবারিক ও প্রশাসনিকভাবে স্মরণের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং তার শততম মৃত্যুবার্ষিকীর বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা পারিবারিক মিউজিয়ামটিও স্বজনদের দ্বন্দ্বে চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিকর্মীসহ হাসন রাজার গানের অনুরাগীরা। বিশেষ করে তার প্রতি পরিবারের উদাসীনতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে। এ ছাড়া যেসব শিল্পী তার গান গেয়ে পরিচিতি পেয়েছেন, তার শততম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাদের নীরবতায়ও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
হাসন রাজার সংগীতানুরাগী ও গবেষকরা জানান, হাসন রাজার বাবা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী সিলেটের রামপাশা থেকে সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রীতে এসে বসবাস শুরু করেন। এখানেই হুরমত জাহান চৌধুরীর গর্ভে জন্ম নেন হাসন রাজা চৌধুরী। তার কবিত্ব লক্ষণশ্রীর পরিবেশেই বিকশিত হয়। ঘোড়া, কোড়া পাখি, নৌকায় হাসন রাজা বজরা ভাসিয়ে আনন্দে মাততেন। সৃষ্টির উন্মাদনায় বিভোর থাকতেন। কোড়া পাখি শিকার ছিল তার নেশা। বিষয়াসক্তহীন হাসন রাজা বৈরাগ্যের বেশে থাকতেই পছন্দ করতেন এবং এই পরিবেশেই সংগীত রচনা করতেন।
জেলার একাধিক গবেষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মরমী কবি হাসন রাজাকে বলেছেন ‘গ্রাম্যকবি’ ও ‘সাধক কবি’। ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের সভায় এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৩০ সালে লন্ডনে হিবার্ট বক্তৃতায় হাসন রাজার গানে মানবদর্শন নিয়ে আলোচনা করেন রবীন্দ্রনাথ। ওই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গের এক গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই। সেটি এই যে, ব্যক্তিস্বরূপের সহিত সম্বন্ধ সূত্রেই বিশ্বসত্য।’
জমিদার হয়েও বিষয়-আশয়ের প্রতি নিরাসক্ত হাসন রাজা গানে গানে মানবতাবাদের কথা বলেছেন। জীবনের কামনা, বাসনা এবং জগৎসৌন্দর্য ও জিজ্ঞাসার বর্ণনা রয়েছে তার গানে। তার গানে তুমুল আত্মজিজ্ঞাসা বিদ্যমান। সামাজিক অসঙ্গতি, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তার বাণী শাণিত হয়েছে। সব ধর্মের সমন্বয়ের কথা রয়েছে তার গানের ছত্রে। এখনো তার গানগুলো প্রাসঙ্গিক ও জনপ্রিয়। জাতীয়, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবেও বাঙালিরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার গান পরিবেশন করেন থাকেন। তা ছাড়া অবিভক্ত ভারতের গোহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় হাসন রাজার গান পাঠ্য ছিল।
মরমী কবি হাসনরাজাকে নিয়ে সর্ব প্রথম মুরারি চাঁদ কলেজ (এমসি কলেজ) বার্ষিকীতে এই অঞ্চলের আরেক প্রতিভাধর ব্যক্তি প্রভাত কুমার শর্মা আলোচনা করেন। ‘হাছন উদাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণেও ভূমিকা লেখেন তিনি। হাসন রাজার গান শান্তিনিকেতনে নিজে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রভাত কুমার শর্মা। হাসন রাজার বৈশ্বিক পরিচিতি ও সৃষ্টি সারা বিশ্বে পৌঁছে দিতে দূতের কাজ করেছিলেন তিনি। পরে নিখিল ভারতের বিখ্যাত সংগীত মহাজন নির্মলেন্দু চৌধুরী হাসন রাজার গান পরিবেশন করেন। তারপর দুই বঙ্গের বিখ্যাত সংগীত মহাজনরা হাসন রাজার গান পরিবেশন করেন।
সুনামগঞ্জে প্রয়াত সাহিত্যিক আব্দুল হাই হাসন রাজাকে নিয়ে গত শতাব্দীতে লিখেছেন। সংগীতশিল্পী আব্দুল লতিফ ও সাব্বির আহমদ মিনুসহ স্থানীয় শিল্পীরা হাসন রাজার গান গেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন। অমর কথাকার ও নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ তার একাধিক নাটকে হাসন রাজার গান ব্যবহার করেন। আশির দশক থেকে বিখ্যাত শিল্পী সেলিম চৌধুরী হাসন রাজার গান গেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এখনো এই প্রজন্মের অনেক শিল্পী হাসন রাজার গান গেয়ে নিজেদের পরিচিতি পেয়েছেন। কিন্তু হাসন রাজার গানের দর্শন ছড়িয়ে দিতে নীরব বলে মনে করেন অনেকে।
হাসন রাজার সৃষ্টি ও স্মৃতিকে ধরে রাখতে তার প্রপৌত্র দেওয়ান সামারিন রাজা চৌধুরী পারিবারিক মিউজিয়ামটিকে সমৃদ্ধ করায় হাত দেন এক দশক আগে। হাসন রাজার সৃষ্টি ও স্মৃতি তিনি জড়ো করেন। এতে দেশ-বিদেশের গুণীজনরা এসে মিউজিয়াম দেখে হাসন রাজার সৃষ্টির সান্নিধ্য লাভ করেন।
চলতি বছরের জুন মাসে পারিবারিক বিবাদের কারণে হাসন রাজার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে সেই মিউজিয়াম। যার ফলে এখন দেশ-বিদেশ থেকে আগত সুধীজন মিউজিয়াম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা হাসন রাজার স্মৃতি দর্শন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া হাসন রাজা একাডেমি কাম শিল্পকলা একাডেমি নামে ২০০৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটি ভবনের নামকরণ করলেও পরবর্তী সময়ে হাসন রাজা একাডেমি বাদ দিয়ে শুধু শিল্পকলা একাডেমি নামে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। এর মিলনায়তনের নামকরণ করা হয় হাসন রাজা মিলনায়তন।
হাসন রাজার প্রপৌত্র ও হাসন রাজা মিউজিয়ামের পরিচালক দেওয়ান সামারিন রাজা চৌধুরী বলেন, অনেক কষ্ট করে মিউজিয়ামটি সমৃদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু হাসন রাজার বিশাল জমিদারির মধ্যে সেই মিউজিয়ামের জায়গা হয়নি। তার স্মৃতি ও সৃষ্টিকে আমাদের স্বজনরাই উপেক্ষা করছেন। তিলে তিলে গড়ে তোলা মিউজিয়ামটি উচ্ছেদ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া সরকার হাসন রাজা একাডেমি নামে ভবন অনুমোদন দিলেও সেটিও প্রতিহিংসাবশত বাদ দিয়ে শিল্পকলা একাডেমি ভবন নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এভাবে এখনো হাসন রাজার প্রতি উদাসীনতা দেখা যায়। অথচ তার গান বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক হয়ে উঠেছে বহু আগেই।
গবেষক ইকবাল কাগজী বলেন, হাসন রাজা যুগসচেতন মরমী সাধক ছিলেন। সামাজিক ও ধর্মীয় অসঙ্গতির বিরুদ্ধে তিনি সব ধর্মের মিলনের গান গেয়েছেন। তার সেসব গান বাদ দিয়ে শিল্পীরা শুধু জনপ্রিয় কিছু গান পরিবেশন করেন। তার গানে মানবতাবাদের যে অমর সুর রয়েছে, সেটি ছড়িয়ে দিতে পারলে আমাদের প্রজন্ম উপকৃত হবে। তাই এই কাজ হাসন রাজার গানের শিল্পীরা করতে পারেন। কিন্তু শিল্পীরা নীরব।
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ মহিবুল ইসলাম বলেন, তার স্বজনরা হাসন রাজার পরিচয় দেন গর্ব ভরে। কিন্তু হাসন রাজার সৃষ্টি, জীবনদর্শন ও স্মৃতির সঙ্গে মানুষের পরিচিত করিয়ে দিতে উদাসীন তারা। তিনি হাসন গবেষক ও শিল্পীদের হাসন রাজাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার আহ্বান জানান।
সুনামগঞ্জ জেলা কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী পাভেল বলেন, হাসন রাজার মৃত্যু দিবসে এবার কোনো কর্মসূচি নেই। আমি ঢাকায় অফিসের কাজে থাকায় কোনো কর্মসূচি হচ্ছে না। তবে হাসন রাজার সম্মানে জেলা শিল্পকলা ভবনের একটি কক্ষের নামকরণ এবং শিল্পকলা একাডেমির প্রবেশপথে আমরা তার ভাস্কর্য গড়েছি।