অভিযোগ ছিল, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুরে সেই সময়ের কলেজছাত্র লিমন হোসেনকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করেছিল র্যাব। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ লিমনের একটি পা কেটে ফেলতে হয়।
ওই বছরেরই ১০ এপ্রিল র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলাটি করেন লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম।
দীর্ঘ ১১ বছর পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তবে এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সোমবার আদালতে নারাজিপত্র দিয়েছেন মামলার বাদী হেনোয়ারা বেগম।
সোমবার বেলা ১২টায় ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে নারাজিপত্রটি দাখিল করা হয়। এ অবস্থায় নারাজির শুনানির জন্য আগামী ৩ জানুয়ারি দিন ঠিক করেছেন আদালতের বিচারক এ এইচ এম ইমরুনুর রহমান।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র নিয়োজিত লিমনের মায়ের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আককাস সিকদার নিউজবাংলাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে র্যাব-৮ এর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় তৎকালীন কলেজছাত্র লিমন হোসেন গুলিবিদ্ধ হন।
পরে লিমনের বাম পা হাটু থেকে কেটে ফেলেন রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এ ঘটনায় বরিশাল র্যাব-৮ এর তৎকালীন ডিএডি লুৎফর রহমান, কর্পোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. আব্দুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহ্লাদ চন্দ এবং কার্তিক কুমার বিশ্বাস সহ অজ্ঞাতনামা আরও ৬ র্যাব সদস্যকে অভিযুক্ত করে ঝালকাঠির আদালতে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন লিমনের মা।
ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজাপুর থানা পুলিশের এসআই আব্দুল হালিম তালুকদার ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে র্যাব সদস্যদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন।
লিমনের মা হোনোয়রা বেগম ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে নারাজি দাখিল করেন।
আদালত ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তার নারাজি আবেদন খারিজ করে দেয়। পরে খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ রিভিশন আবেদন করেন হেনোয়রা বেগম।
২০১৮ সালের ১ এপ্রিল অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এস কে এম তোফায়েল হাসান রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করেন। রিভিশন মঞ্জুর হওয়ার পর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সেলিম রেজা মামলাটি তদন্তের জন্য ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে নির্দেশ দেন।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে আবারও থানা পুলিশের মতো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, লিমনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা সত্য। তবে কারা তাকে গুলি করেছে তার কোনো সাক্ষী প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে সাক্ষী ও প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে।
তবে এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করে লিমনের মা দাবি করেন, তার ছেলে সন্ত্রাসী ছিলেন না। একটি ভালো ছেলেকে র্যাব গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু ও সঠিক বিচার দাবিও করেন তিনি।
উল্লেখ্য র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে পা হারানো লিমন হোসেন ২০১৩ সালে এইচএসসি, ২০১৮ সালে আইন বিষয়ে অনার্স, ২০১৯ সালে এল এল এম পাস করেন।
২০২০ সালে তিনি সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিভাগের সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
সাংবাদিকদের লিমন বলেন, ‘র্যাব অন্যায়ভাবে আমাকে গুলি করে পঙ্গু করে দিয়েছে। আমি অনেক কষ্ট করে মানুষের ভালোবাসায় পড়াশোনা শেষ করেছি ঠিকই, কিন্তু আমার পা হারানোর কষ্ট ভুলতে পারছি না। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন যারা আমাকে পঙ্গু করেছে তাদের বিচার দাবি করবো।’
২০১১ সালে ঘটনার পর লিমনকে সন্ত্রাসী দাবি করে র্যাব লিমনসহ আট জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে দুটি মামলা করেছিল। দুটি মামলাতেই লিমনসহ বাকি আসামিরা আদালত থেকে ২০১৮ সালে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।
ঘটনার শুরু থেকে লিমনকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।