ধোঁয়া উঠা গরম ভাতে সিদল শুঁটকির ভর্তার স্বাদ নেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। এক সময় কুমিল্লায় তৈরি সিদলের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ছিল সারা দেশে। তবে সহজ শর্তে ঋণের অভাবে ও নদী এবং খাল-বিলে মাছ কমে যাওয়ায় সংকটে পড়েছেন এখানকার শুঁটকি কারিগরেরা।
শতবছর আগে সিদল শুঁটকি তৈরি শুরু হয় কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার সলফা গ্রামে। বর্তমানে ওই গ্রামের চারটি পরিবার তাদের বাপ-দাদার আদি এ পেশাকে ধরে রেখেছেন। এক সময় ওই গ্রামের ৪০টি পরিবার সিদল তৈরির কাজ করতো। তবে ঋণ ও মাছের অভাবে অনেকে আবার পেশা বদল করেছেন।
সালফা গ্রামে এখন চারটি পরিবার সিদল শুঁটকি তৈরির সঙ্গে জড়িত। সরেজমিনে সালফা গ্রামে দেখা যায়, মাচায় সিদল শুকানোর কাজ করছেন রবিন্দ্র চন্দ্র ও বিষ্ণু চন্দ্র সরকার।
রবিন্দ্র বলেন, ‘আমরা দুই জাতের সিদল করি। একটি হচ্ছে পোয়া অন্যটি পুঁটি সিদল। পোয়া মাছ চট্টগ্রাম থেকে সংগ্রহ করি। পুঁটি মাছগুলো মেঘনা ও সিলেট এলাকা থেকে সংগ্রহ করি।’
যেভাবে তৈরি হয় সিদল
সিদল তৈরির কারিগর রবীন্দ্র ও বিষ্ণু জানান, আশপাশের নদী ও খাল থেকে পুঁটি মাছ সংগ্রহ করি। বিশেষ করে স্থানীয় বাজার থেকেও আমরা কম দামে মাছগুলো কিনে বাড়ি আনি। পরে এগুলোর পেট কেটে বড় পাত্রে পানি দিয়ে পেট-কাটা পুটিগুলো রেখে দেই। আগুন তাপে সেগুলো থেকে তেল বের হয়। তেলগুলো আমরা আরেকটা পাত্রে সংরক্ষণ করি। পরে মাছগুলোকে মাচায় শুকিয়ে নেই।
তারা আরও জানান, শুকানো মাছগুলো বড় মটকির ভেতর রেখে এর আগে আগুনের তাপে বের হওয়া মাছের তেল ঢেলে দেই। মাটি খুড়ে মটকিগুলো পুতে রাখি। তিন মাস মাটির নিচে রাখার পর তৈরি হয় সিদল।
চলতি বছরের সিদল তৈরির কেমন প্রস্তুতি
সিদল তৈরির কারিগর রবিন্দ্র চন্দ্র সরকার বলেন, ‘এখন আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। তবুও এ বছর যা সংগ্রহ করেছি তা দিয়ে চারশো থেকে ৫’শ মটকী সিদল তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছি। এগুলো থেকে অন্তত এক’শ মন পুঁটি সিদল তৈরি হবে। প্রতি বছর পৌষ-মাঘ মাসে মটকীগুলো মাটির নীচে গর্ত করে রাখি। মূলত আশ্বিন, কার্তিক মাস থেকে চৈত্র মাস পযর্ন্ত চলে সিদল তৈরির কাজ।
কোথায় যায় কুমিল্লার সিদল
কুমিল্লার মুরাদনগরের সিদলের বেশ চাহিদা আছে। নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে কুমিল্লার সিদল চলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা সদরে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে চট্টগ্রামে। শুধু দেশেই নয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে কুমিল্লার সিদল যাচ্ছে ভারতের আগরতলা, তেল্লামুড়া, সোনামূড়ায়। সেখান থেকে পাইকাররা এসে সিদল নিয়ে যান।
সিদল শুঁটকি তৈরির পেশা টিকিয়ে রাখতে আকুতি
মুরাদনগরের সলফা গ্রামের বিষ্ণু ও রবীন্দ্রসহ আরও দুটি পরিবার এখন সিদল শুঁটকি তৈরি করে। তাদের এই কাজে সহযোগিতা করেন শতাধিক নারী। সিদল তৈরির কারিগর বিষ্ণু বলেন, শত বছর ধরে বংশ পরম্পরায় আমরা নানান সংকটের মুখে পড়ে সিদল তৈরির পেশাটাকে জিইয়ে রেখেছি। সরকার যদি সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে আমাদের সহায়তা করে তাহলে সিদল উৎপাদন করে এই শিল্পটাকে টিকিয়ে রাখতে পারতাম।