বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঠাটারী বাজারের আড়তে বছরে চাঁদা কোটি টাকা

  •    
  • ৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ১৮:৩৮

ঠাটারী বাজার মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মো. বাহাউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাঁদা দেব না। ইজারাদারের বিষয়টা নিয়ে আদালতের স্থিতাবস্থা আছে। আমরা আর চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি থাকতে চাই না।’

রাজধানীর কাপ্তানবাজারের ঠাটারী বাজারে ১৯৯টি মাছ ও তরকারির আড়ত থেকে দুই বছরে ২ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলার অভিযোগ উঠেছে। এই টাকা জমা পড়েনি সরকারি কোষাগারে।

আড়তের ব্যবসায়ীরা সিটি করপোরেশন থেকে দোকান বরাদ্দ পেলেও সম্প্রতি নিয়োগ করা হয়েছে ইজারাদার। দুই বছর চাদাঁবাজি চলার পর ইজারাদার নিয়োগের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ।

বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন ব্যবসায়ীরা। আদালত এ বিষয়ে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ইজারা কার্যক্রমে স্থিতাবস্থা দিলেও তা লঙ্ঘনের চেষ্টা চলার অভিযোগ উঠেছে।

ঠাটারী বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, স্থানীয় কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফীর ছত্রচ্ছায়ায় তার চাচাতো ভাই ইয়াছির দৈনিক ভিত্তিতে দুই বছর চাঁদা তুলেছেন। ইয়াছির চাঁদা টাকা তুলতেন জামাল নামে একজন ব্যবসায়ীকে দিয়ে। এরপর গত অক্টোবরে ইজারাদার নিয়োগ দেয় দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশন। তিনিও স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুসারী।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে কাউন্সিলর ইমতিয়াজের দাবি, সরকারিভাবে রাজস্ব আদায়ের উদ্যোগ নেয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচার’ চলছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৯৬ সালে মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সময় ঠাটারী বাজারে একতলা একটি ভবনে ১৯৯ ব্যক্তিকে দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়। এরপর মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন তাদের চূড়ান্ত বরাদ্দপত্র দেন। দোকানপ্রতি মাসিক ভাড়া ৮০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘২০২০ সালে করোনার সময় ঝামেলা শুরু হয়। ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে ভবনটি ভেঙে ফেলে সিটি করপোরেশন। তখন কথা ছিল নতুন ভবন নির্মাণ করে আগের চুক্তি অনুযায়ী দোকান বরাদ্দ দেয়া হবে।

‘তবে এখনও সেই ভবন নির্মাণ করা হয়নি। আর ওই জায়গায় ব্যবসায়ীদের অস্থায়ী দোকানে শুরু হয় কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফীর চাচাতো ভাই ইয়াছিরের চাঁদাবাজি।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘কাউন্সিলর শুরুতে টিনের ঘের দিয়ে বাজারের জায়গাটি আটকে দিতে চেয়েছিলেন। আমরা জায়গাটি উন্মুক্ত রাখার অনুরোধ করলে তিনি জানান, ব্যবসা করতে হলে রাজস্ব দিতে হবে। তবে এই রাজস্ব সরকারকে নয়, দিতে হবে তার চাচাতো ভাই ইয়াছিরকে। এরপর ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত একটানা চলে চাঁদাবাজি।’

ঠাটারী বাজারের বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা (বাঁয়ে) এবং কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী

ঠাটারী বাজারের ষাটোর্ধ্ব এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘শুরুতে দিনে প্রতি দোকান থেকে ২০০ টাকা করে দিতে বলেছিলেন ইয়াছির। পরে তা একটু কমানো হয়। ওই বছর প্রথম ছয় মাস প্রতিদিন এই ১৯৯ দোকান থেকে দেয়া হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা করে। পরের ছয় মাস কাউন্সিলরের লোকজন দিনপ্রতি নেন ২৮ হাজার করে টাকা। গত বছরের অক্টোবর থেকে দিনে ৩১ হাজার করে টাকা নিয়েছেন। এ বিষয়ে মেয়রকেও লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে।’

দুই বছর ধরে নীরবে চাঁদা দেয়ার কারণ জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের দোকান বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভবন ভাঙার পর তো ব্যবসা করারই সুযোগ ছিল না। ফলে ব্যবসা করার জন্য কমিশনার ও তার লোকদের টাকা দেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।’

সম্প্রতি জায়গাটি মো. কামরুজ্জামান নামে একজনকে বছরে ৩৮ লাখ টাকায় ইজারা দেয় সিটি করপোরেশন। এর বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীরা হাইকোর্টে রিট করলে আদালত স্থিতাবস্থা দেয়।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আদালতের আদেশ অমান্য করে গত ২৮ নভেম্বর ইজারাদার কামরুজ্জামানের পক্ষে ঠাটারী বাজারে মাইকিং করে একটি পক্ষ। বলা হয়, ১ ডিসেম্বর থেকে ইজারাদারকে অর্থ দিতে হবে। এর প্রতিবাদে ওই দিন দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দোকান বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করেন দোকান মালিকরা।

উচ্চ আদালতের আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ৩০ নভেম্বর রাতে ডিএমপির ওয়ারী থানায় ব্যবসায়ীরা সাধারণ ডায়েরিও করেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, জিডি করার পর থানা থেকে ঠাটারী বাজার ফেরার পথে স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজনের হামলায় অন্তত ২০ জন আহত হন। এর প্রতিবাদে ১ ডিসেম্বর সকাল থেকে ঠাটারী বাজারের মৎস্য ও তরকারি আড়তের ১৯৯টি দোকান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়। অবশ্য পুলিশের আশ্বাসে শুক্রবার দোকান খুলেছেন ব্যবসায়ীরা।

আদালতের আদেশ না মেনে টোল আদায়ের চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করছেন ইজারাদার মো. কামরুজ্জামান। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশন এখনও আমাকে বাজার বুঝিয়ে দেয়নি। আমি এখনও বাজারে যাইনি। সিটি করপোরেশন বুঝিয়ে দেয়ার পর যাব।’

তবে ডিএসসিসি বলছে, ইজাদারকে অনেক আগেই বাজার বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) মো. রাসেল সাবরিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ইজারাদারকে বাজার বুঝিয়ে দিয়েছি। তবে জায়গার মাপ নিয়ে একটু সমস্যা আছে, যেটা কয়েক দিনের মধ্যে সমাধান করে দেয়া হবে।’

আদালতের স্থিতাবস্থা জারির বিষয়ে প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা যা করছি, সবই আদালতের নির্দেশনার মধ্যে থেকেই করছি।’

বাজার থেকে দুই বছরে ২ কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলার সঙ্গে নিজের স্বজন বা অনুসারীদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করছেন ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী। তার দাবি, চাঁদাবাজির সঙ্গে ব্যবসায়ীদের একটি অংশই জড়িত।

ইমতিয়াজ মন্নাফী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। এত বছর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে একটা শ্রেণি চাঁদা নিত। এবারই প্রথম ইজারার মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের তহবিলে টাকা জমার বিষয়টি এসেছে। এতে ওই চাঁদাবাজ লোকজন লসে পড়েছে।

‘তাই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা এখন আমার নামে বদনাম করছে। আমি বা আমার কাছের লোকজনের নামে যে তথ্য ছড়াচ্ছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন।’

বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা য়ায়, কাপ্তানবাজারসংলগ্ন অংশে ঠাটারী বাজারের অবস্থান। ৩৮ নং কাউন্সিলরের অফিস থেকে অদূরে সেদিন বাজারের সব দোকান বন্ধ ছিল। ইজারা বাতিল ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি নিয়ে সোচ্চার ব্যবসায়ীরা।

স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ীদের হুমকি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে

ব্যবসায়ীদের এই অবস্থান চলার সময় দুপুর দেড়টার দিকে স্থানীয় শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুর রহমান ২০-২৫ জনকে নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ঘটনাস্থলে আসেন।

বাহাউদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীকে হুমকি দিতে দেখা যায় আব্দুর রহমানকে। তিনি উচ্চকণ্ঠে বলছিলেন ‘দোকান বন্ধ রাখা যাবে না। আমাদের সঙ্গে ঝামেলা করতে আইসেন না। আমরা এলাকাতেই থাকমু। দোকান খোলেন।’

আব্দুর রহমান সম্পর্কে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি কাউন্সিলরের লোক। এখানে মাস্তানি করতে আসছেন। জোর করে ওরা সব আদায় করতে চায়।’

ঠাটারী বাজার মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি মো. বাহাউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাজারের ব্যবসায়ীদের গ্রাস করার জন্য ওরা আমাদের ওপর হামলা করছে। আমরা জিডি করে আসার সময় লাঠিসোঁটা নিয়ে ব্যবসায়ীদের মারছে। দোকানের শাটার ভাঙার চেষ্টা করছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চাঁদা দেব না। ইজারাদারের বিষয়টা নিয়ে আদালতের স্থিতাবস্থা আছে। আমরা আর চাঁদাবাজদের কাছে জিম্মি থাকতে চাই না।’

ইজারাদার কামরুজ্জামানও কাউন্সিলরের লোক বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। তাদের দাবি, এলাকায় অপরিচিত কামরুজ্জামানের নাম ব্যবহার করে কাউন্সিলরই ইজারা নিয়েছেন।

কামরুজ্জামানের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করছেন না কাউন্সিলর আহমেদ ইমতিয়াজ মন্নাফী।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে। কার লোক কী বিষয়, এটা তো সরকার দিয়েছে। সরকার এটার জন্য রাজস্ব পেয়েছে। এই টাকা বাজারের যারা আছে তারা কখনও সরকারকে দেয়নি।’

ব্যবসায়ীদের দোকান বরাদ্দ পাওয়া নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘যারা এখন বাজারে আছে তাদের কাছে কি মালিকানার কোনো ডকুমেন্ট আছে? তাদের কাগজ দেখাতে বলেন। আমি তো আমার কাগজ (ইজারা) দেখাইছি। দেশে তো আইন আছে। আইনের বাইরে তো যাব না। আমি একজন জনপ্রতিনিধি।

‘ল্যান্ডের মালিক সিটি করপোরেশন। আমি এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে সিটি করপোরেশনকে সার্ভ করি। এ জন্য আমার নাম আসবে, এটা ন্যাচারাল। এই বাজারে এক্স ওয়াই জেডরা তাদের বেনিফিট হারাচ্ছে, এখন গর্ভমেন্ট রাজস্ব পাবে। এটা তারা মানতে পারছে না।‘

বাজারে চাঁদাবাজির ঘটনায় চাচাতো ভাইসহ ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের নাম আসার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলরের যারা পলিটিক্যাল লোক থাকে, তাদের সবারই নাম আসবে। আমি কাপ্তানবাজার মালিক সমিতির সভাপতি। অন্যদিকে ময়না ও বাহাউদ্দিন দুজনই আমার এলাকার বাসিন্দা না। তারাই মাছ বাজার থেকে টাকা ওঠাত। আমি যখন এটাকে গর্ভমেন্ট রাজস্বে ফালাইছি তখন থেকেই তারা মানতে পারছে না।’

এ বিভাগের আরো খবর