বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কিশোরী রানীর ভাতের পাতিলে লুকানো পিস্তল-গুলি

  •    
  • ২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৮:৩৭

কুমিল্লার গৃহবধূ কিশোরী রানী শর্মা মুক্তিযুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। পাড়ি দিয়েছেন শত্রু এলাকা। তার স্বামী মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সারাই করে দিতেন। তাদের মেলেনি মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি।

ভারতের সোনামূড়া। ডিসেম্বর শুরু। শীতের সন্ধ্যা। চারদিকে আবছা কুয়াশা। রান্নার পাতিলে ভাতের ভেতর পিস্তল ও গুলি লুকিয়ে মুক্তিযোদ্ধারের কাছে যাচ্ছিলেন এক গৃহবধূ।

পথে আচমকা পাকিস্তানিরা দূর থেকে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পড়ে যান গোমতী নদীতে। স্রোতের টানে ভেসে যান অনেকদূর। মৃত ভেবে পাকিস্তানিরা চলে যায়। ঘটনার পর মুক্তিযোদ্ধারা আসেন। উদ্ধার করেন ওই গৃহবধূকে। ক্যাম্পে নিয়ে গুলি বের করেন। বাম কনুইয়ের ওপর গুলির দাগ আজও সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা মনে করে দেয়।

গৃহবধূর নাম কিশোরী রানী শর্মা। তার স্বামী অরুণপ্রসাদ শর্মাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অস্ত্র তৈরি করা, বিকল অস্ত্র ঠিক করার দায়িত্ব ছিল অরুণপ্রসাদ শর্মার ওপর। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও স্বামী-স্ত্রীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি। মনের ভেতর কষ্ট নিয়েই বছর দশেক আগে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান অরুণপ্রসাদ।

কিশোরী রানী শর্মার বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার মধ্যম বিজয়পুরে। তার এক ছেলে এক মেয়ে। বছরচারেক আগে কিশোরী রানীর একমাত্র ছেলে বাসুপ্রসাদ শর্মা ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান। এক মেয়ে বিজয়পুর মৃৎশিল্প কারখানার কাজ করেন। ৫ হাজার টাকা বেতন। এই টাকা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছেন তারা।

সরেজমিনে মধ্যম বিজয়পুরে গিয়ে দেখা যায়, কিশোরী রানীর বাড়ির সামনে একটি খাল। নড়বড়ে সাঁকো পার হয়ে সামনে গেলে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে শুয়ে থাকতে দেখা যায় কিশোরী রানী শর্মাকে।

শোয়া থেকে উঠে ভাঙা কণ্ঠে কিশোরী রানী জানান, ১৯৩৭ সালে তার জন্ম। জাতীয় পরিচয়পত্রে তারিখটা লেখা ৬ মে। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী অরুণপ্রসাদ অস্ত্র বানাতে পারতেন। ভাঙা অস্ত্র ঠিক করতে পারতেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও স্বীকৃতি পাননি। ১০ বছর হলো তিনি মারা গেছেন।’

স্মৃতির ঝাঁপি খুলে কিশোরী রানী বলেন, ‘শীতের রাতে কতবার বিবিরবাজার বর্ডার ক্রস করে ভারতের সোনামুড়া গেছি। সেখানে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ হতো। প্রতিবার পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিতে কত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছি। গুলি খেয়ে নদীতে পড়ে গেছি। তবুও মুক্তিযুদ্ধ করে গেছি।

‘আমরা মেজর এনামের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছি। অথচ আজ আমাদের স্বামী-স্ত্রীর কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। আমার ছেলেটা মারা গেল। একমাত্র মেয়ে আর ছেলের ঘরের নাতি-নাতনিদের নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। কেউ আমাদের খবর রাখে না। আমার স্বামী বেঁচে থাকতে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিল। আমিও করেছি। কেউ আমাদের স্বীকৃতি দেয় না।’

বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, ‘ভারতীয় তালিকা, দেশের গেজেট ও লাল তালিকায় কিশোরী রানী ও তার স্বামী অরুণের নাম নেই। তাই তাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া যাচ্ছে না। তবে তারা যদি মন্ত্রণালয় বা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কাছে গিয়ে প্রমাণ করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তাদের নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।’

কিশোরী রানী শর্মার মেয়ে পান্না রানী শর্মা বলেন, ‘মাকে নিয়ে কত কষ্টে আছি, কেউ না এলে বুঝবেন না। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে বিনা শর্তে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল আমার বাবা-মা। অথচ আজ আমার মা ও বাবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে কত শর্ত মানতে হবে। এর চেয়ে দুঃখের কী আছে! আমি আশা করব, একদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঠিকই আমাদের বাবা-মাকে স্বীকৃতি দিবেন। কারণ পৃথিবীতে অনেক সত্য আছে, যেগুলোর জন্য প্রমাণ লাগে না। আমার বাবা-মাও তেমন।’

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শুভাশিস ঘোষ বলেন, ‘আমি কিশোরী রানী শর্মাকে চিনি। তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা শুনেছি। তিনি ও তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তবে যথাযথ ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করতে পারেননি বলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি। আমি আশা করব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন তার এই ত্যাগের বিষয়টি মূল্যায়ন করেন। তিনি যেন তার প্রাপ্য পান। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন। সেখানে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে এসে যদি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তার স্বীকৃতি না পান, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক।’

এ বিভাগের আরো খবর