চলতি বছর খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের এআরটি (অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি) সেন্টারে ৬৫ জনের নমুনায় এইডসের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালে শনাক্ত হয়েছিলেন ২৮ জন, ২০২০ সালে ৩২ জন ও ২০১৯ সালে ৪২ জন।
এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ২০১৯ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এইডস শনাক্তের হার কমলেও ২০২২ সালে এসে হঠাৎ করেই তা বেড়ে গেছে!
হাসপাতাল সূত্র জানায়, চলতি বছর এআরটিতে ৯২৩ জনকে এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়। তার মধ্যে ৬৫ জনের নমুনায় এইচআইভি জীবাণু পাওয়া যায়। শনাক্তদের মধ্যে ৩৩ জন পুরুষ ও ২৯ জন নারীর পাশাপাশি ৩ শিশুও রয়েছে। শিশুদের মধ্যে ২ জন মেয়ে ও ১ জন ছেলে।
এ ছাড়া এবার আক্রান্তদের মধ্যে খুলনার ২৮ জন, নড়াইলের ৯ জন, বাগেরহাটের ৮ জন, সাতক্ষীরার ৭ জন, যশোরের ৭ জন, ঝালকাঠির ২ জন এবং পিরোজপুর, মাগুরা, চাঁদপুর ও বরিশালের ১ জন করে।
এ ছাড়াও চলতি বছরে এইডসে আক্রান্ত হয়ে খুলনাঞ্চলে মারা গেছেন ১৮ জন। যার মধ্যে রয়েছেন খুলনার ৮ জন, যশোরের ৪ জন, নড়াইলের ৩ জন, বাগেরহাটের ২ জন ও পিরোজপুরের ১ জন।
এর আগে ২০২১ সালে এ অঞ্চলে এইডস আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন ৭ জন। যার মধ্যে খুলনার ৪ জন, বাগেরহাটের ২ জন এবং নড়াইলের একজন। এ হিসেবে দেখা যায়, গত বছরের তুলনায় এ বছর এইডসে খুলনাঞ্চলে মৃত্যুর হারও বেশি।
খুমেক হাসপাতালে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১৫৮ এইচআইভি পজিটিভ রোগী নিয়ে এআরটি সেন্টার যাত্রা শুরু করে। সেখানে থেকে এ পর্যন্ত ৫১৬ জন এইচআইভি পজিটিভ রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে এইডসে মারা গেছেন ৪৫ জন।
বর্তমানে এ সেন্টারে নিয়মিত চিকিৎসাধীন রোগী আছেন ৪১৪ জন, অনিয়মিত ৪৫ জন এবং এখান থেকে রেফার করা হয়েছে ১২ জনকে।
বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে এ অঞ্চলের ৯৩ জন যৌনকর্মীও রয়েছেন।
খুমেক হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার (মেডিসিন) এবং এরআরটি সেন্টারের ফোকাল পার্সন ডা. দীপ কুমার দাস বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার খুলনাঞ্চলে এইডস পজিটিভ বেশি পাওয়া গেছে। সরকার এদের জন্য বিনামূল্যে দামি ওষুধগুলো দিচ্ছে। ওষুধ দেয়ার আগে যত ধরনের রুটিন টেস্ট আছে সবকিছুই বিনা মূল্যে এআরটি কর্নার থেকে করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে খুলনাঞ্চলে এইডস এর ঝুঁকি বেশি। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রচুর। একমাত্র সচেতনতা ছাড়া এ রোগে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’
তিনি জানান, যেসব গর্ভবতী মা এইচআইভি পজিটিভ, কিন্তু জানতে পারেননি- তাদের ক্ষেত্রে বাচ্চাটিরও এইচআইভি পজিটিভ সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক সময় শিশু মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়ে। যদি গর্ভবতী থাকা অবস্থায় ওই মা নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন সে ক্ষেত্রে শিশুটির এইডস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘বাবা-মায়ের ভুলের কারণে কিংবা অন্যদের সামান্য অসচেতনার কারণে অনেক শিশুই বহন করে চলেছে ভয়াবহ এইডস জীবাণু। বর্তমানে এই হাসপাতালে গর্ভবতী কোনো নারীর সিজার করা হলে বাধ্যতামূলকভাবে তার এইডস পরীক্ষা করাও হচ্ছে। এ ছাড়া এইডস পজিটিভ রোগীদের বিনা মূল্যে অনেক দামি ওষুধ দেয়া হচ্ছে।’
২০১৮ সালে ‘শিশু, এইচআইভি ও এইডস: ২০৩০ সালের বিশ্ব’ শিরোনামে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে এইডস-সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হতে পারে। এর অর্থ হচ্ছে এইচআইভি প্রতিরোধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা প্রকল্পে বাড়তি বিনিয়োগ করা না হলে প্রতিদিন ৭৬ জন কিশোর-কিশোরীর মৃত্যু হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা বজায় থাকলে এইচআইভিতে আক্রান্ত ০-১৯ বছর বয়সীদের সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে আনুমানিক ২ লাখ ৭০ হাজারে পৌঁছাবে। যা বর্তমানের অনুমানের চেয়ে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এইডস-সম্পর্কিত কারণে মারা যাওয়া শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা ভবিষ্যতে কমবে।
ইউনিসেফের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৬৪ জেলায়ই এইডস আক্রান্ত রোগী ছড়িয়ে আছে। অধিকাংশ আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায়। আক্রান্তদের বেশিরভাগ নারী-পুরুষই অভিবাসী শ্রমিক।
বাংলাদেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এখনও খুব বেশি নয়; মোট জনসংখ্যার ০.১ শতাংশ। তবে নতুন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
১৯৮৮ সাল থেকে প্রতিবছর ১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়। সারা বিশ্বের মতো এবারও বাংলাদেশে দিবসটি পালন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অসমতা দূর করি, এইডস মুক্ত বিশ্ব গড়ি’।