বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভাটার শ্রমিকরা জিম্মি সর্দারের কাছে

  •    
  • ২৬ নভেম্বর, ২০২২ ১৬:১০

ইটভাটায় যিনি নানা রকমের শ্রমিক জোগাড় করেন, তাকে বলা হয় শ্রমিক সর্দার বা দালাল। সর্দার সাধারণত ইট তৈরির মাটি কাটা থেকে ইট বিক্রির আগপর্যন্ত সব কাজ শ্রমিকদের দিয়ে করিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার ইট তৈরি করতে সর্দাররা ভাটার মালিকের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন।

৪০ বছর বয়সী আশরাফ আলীর বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলায়। ছয় মাস ইটের ভাটায় কাজ করতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন এক সর্দারের (দালাল) সঙ্গে। তিনি কাজ করবেন খুলনার ডুমুরিয়ার উপজেলার ইটের ভাটায়।

আশরাফ আলী বলেন, ‘সর্দার আমাদের এলাকা থেকে চুক্তি করে নিয়ে আসেন। পরে ভাটায় এনে অন্য দালালের হাতে তুলে দেন। কখনও আমরা ছয় মাস ধরে একটি ভাটায় কাজ করি। আবার কখনও দুটি বা তিনটি ভাটায় কাজ করতে হয়। আমাদের যে দালাল চুক্তি করে নিয়ে এসেছেন, তার সাথে অন্য দালালদের ঝামেলা হলে আমাদের ভাটাও পরিবর্তন করতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘গত বছর মৌসুম শেষ হলে সর্দার আমার ১০ হাজার টাকা আটকে রেখেছিল। এই বছর আবারও তার মাধ্যমে ভাটায় না আসলে ওই টাকা ফেরত পেতাম না। শওকত নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে আমি গত চার বছর ধরে বিভিন্ন ইটের ভাটায় কাজ করছি।’

আশরাফ আলী ভাটায় ইট তৈরির কাজ করেন। প্রতি হাজার ইট তৈরি করে তিনি পান ২০০ টাকা। সাধারণত প্রতিদিন তাকে ২ হাজার ৫০০টি ইট তৈরি করতে হয়। এতে তার মজুরি হয় ৫০০ টাকা। প্রত্যেকটি ইটের ভাটায় এমন শ্রমিকের সংখ্যা ১০০ থেকে ৫০০ জন।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইটভাটায় বিভিন্ন রকমের কাজে আলাদা আলাদা শ্রমিক দরকার হয়। তাদের মজুরিও আলাদা হয়ে থাকে। মাটি কাটার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা (মাইঠেল) কোথাও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে, আবার কোথাও বর্গফুট হিসেবে মজুরি পেয়ে থাকেন। যারা বর্গফুট হিসেবে মজুরি নেন, তারা সাধারণ এক হাজার বর্গফুট মাটি কাটলে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা পান। এ ছাড়া যারা দৈনিক মজুরি নেন, তারা প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মাটি কেটে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা মজুরি পেয়ে থাকেন।

এ ছাড়া, ইট তৈরির উপযোগী করে কাদা-মাটি তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা ভোর ৪টা থেকে কাজে যোগ দেন। প্রতি হাজার ইটের সমপরিমাণ কাদা তৈরি করে তারা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা মজুরি পান।

ইট প্রস্তুতকারী কারিগররা প্রতি হাজার ইটে ১৭০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান। তবে দাদন নেয়া (মজুরি বাবদ আগাম অর্থ নেয়া) শ্রমিকরা প্রতি হাজার ইটে ১১০ থেকে ১২০ টাকা মজুরি পান। ইট তৈরির কারিগরের সহযোগী শ্রমিকরা প্রতি হাজারে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা মজুরি পান। এই সহযোগী শ্রমিকরা সাধারণ শিশু হয়ে থাকে।

এ ছাড়া কাঁচা ইট তৈরির স্থান (পট) থেকে চুল্লি পর্যন্ত বহনকাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা (রেজা) এক হাজার ইট বহনের জন্য পান ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। ভাটার চুল্লি থেকে পোড়া ইট বের করা শ্রমিকরা (পাকা নিকেশি) পান ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।

ভাটাভেদে শ্রমিকসংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে মজুরিও কিছুটা কম-বেশি হয়।

ভাটাগুলোতে টিকিট মাস্টার, রাবিশম্যান এবং ফায়ারম্যান পদে নিয়োজিতরা মাসিক বেতন হিসেবে কাজ করেন। তাদের বেতন মাসে ১৫ থাকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে থাকে।

ইটভাটায় যিনি নানা রকমের শ্রমিক জোগাড় করেন, তাকে বলা হয় শ্রমিক সর্দার বা দালাল। সর্দার সাধারণত ইট তৈরির মাটি কাটা থেকে ইট বিক্রির আগপর্যন্ত সব কাজ শ্রমিকদের দিয়ে করিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার ইট তৈরি করতে সর্দাররা ভাটার মালিকের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত নেন।

লতিফ মোড়ল নামের এক শ্রমিক সর্দার বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে শ্রমিক সংগ্রহ করি। আবার মৌসুম শেষে তাদের ছেড়ে দিই। কাজের শুরুতে শ্রমিকদের সাথে মজুরির চুক্তি করে নিই।’

তবে ইটভাটার একাধিক শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ ভাটায় শ্রমিকরা ঠিকমতো মজুরি পান না। একদিকে ইট বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত মালিকরা টাকা দিতে চান না। অন্যদিকে সর্দাররা টাকা দীর্ঘদিন আটকে রাখেন, যাতে শ্রমিকরা ভাটা ছেড়ে চলে যেতে না পারেন।

অভিযোগ আছে, শ্রমিকদের ভাটার কাজে আটকে রাখতে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করা হয়। ২০২১ সালে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের আজাদ ব্রিকস নামের একটি ইটভাটায়।

পর্যাপ্ত মজুরি না পেয়ে ভাটা ছেড়ে দিতে চাইলে রুহুল আমিন শেখ নামের এক শ্রমিককে রাতভর নির্যাতন করা হয়।

রুহুল আমিন বলেন, ‘ইটভাটায় ছয় মাস কাজ করার জন্য সালাম নামের এক সর্দারের সাথে আমার চুক্তি হয়েছিল। সেখানে আমি ও আমার স্ত্রী আসমা বেগম কাজে যোগ দিই। ওই ভাটায় শ্রমিকদের জন্য অস্থায়ী বসতি আছে। সেখানে একমাত্র সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে অবস্থান করি। চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও সর্দার আমাদের ভাটা থেকে ছাড়তে চাননি। তিনি বলেছিলেন, বর্ষাকাল না আসা পর্যন্ত আমাকে ভাটাতে কাজ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ভাটা থেকে বাইরে বের হওয়ায় সর্দারের লোকেরা মনে করেছিল আমি পালিয়ে যাচ্ছি। তখন তারা আমাকে ধরে নিয়ে যায় ভাটার অস্থায়ী বসতির একটি কক্ষে। সেখানে রাতভর তারা আমার ওপর নির্যাতন শুরু করে। তাদের মার খেয়ে একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন আমার স্ত্রীকেও তারা শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। পরে তারা আমাদের মোবাইল কেড়ে নেয়।

‘পরের দিনও ওই ঘরে আমাদের আটকে রাখে। যাতে আমরা বাইরে কারও সাথে নির্যাতনের কথা বলতে না পারি। বিকেলে এক শ্রমিকের সহায়তায় আমার স্ত্রী ওই কক্ষ থেকে পালিয়ে গিয়ে পুলিশের কাছে যায়। তখন পুলিশ এসে আমাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খুলনা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘ভাটায় সরাসরি আমরা শ্রমিক নিয়োগ দিই না। তারা সর্দারের মাধ্যমে কাজ করেন। তবে কোনো ঝামেলা বাধলে আমরা মিটিয়ে দিই।’

এ বিভাগের আরো খবর