বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট ভেঙে গেছে বলে কুমিল্লার একটি ইউনিটের রুকন সম্মেলনে দলের আমির শফিকুল ইসলামের বক্তব্যের তিন মাসের মধ্যে রংপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা থাকা বিএনপি এই ভোট বর্জন করলেও জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলটির পক্ষে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। ফলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশ নিতে হচ্ছে। তার পরও দলটির এই নেতার প্রার্থিতার বিষয়টি রাজনীতিতে ইঙ্গিতপূর্ণ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৯৯ সালে জোটবদ্ধ হয় জামায়াত ও বিএনপি। এর পর থেকে নির্বাচন, রাজনীতিতে বিএনপি যে পথে চলেছে, একই পথে চলেছে জামায়াতও। বিএনপি ভোট বর্জন করলে তাতে যায়নি জামায়াত। বিএনপি ভোটে গেলে গেছে তারাও।
তবে এই সম্পর্ক যে আগের মতো নেই, সেটি প্রকাশ পায় গত আগস্টের শেষে।
কুমিল্লা জামায়াতের একটি ইউনিটের রুকন সম্মেলনে অনলাইনে যুক্ত হয়ে দলের আমির শফিকুর ইসলাম জানান, বিএনপির সঙ্গে তাদের জোট ভেঙে গেছে।
সেদিন তিনি বলেন, ‘আমরা এতদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। আপনারা শুনে হয়তো ভাবছেন কী হয়েছে এখন। হ্যাঁ, হয়ে গেছে।
‘২০০৬ সাল পর্যন্ত এই জোট দেশের জন্য উপকারী একটা জোট ছিল। ৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এবং সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছে। তার পরে আর ফিরে আসেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বহু চিন্তা করে দেখেছি, এর পর থেকে এই জোট বাংলাদেশের জন্য আর উপকারী জোট নয়।’
জামায়াত আমির সেদিন আরও বলেন, ‘এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছে, বিশেষ করে প্রধান দল এই জোটকে কার্যকর করার তাদের চিন্তা নাই। তাদের যদি চিন্তা না থাকে, তাহলে তা হবে না।
‘এই বিষয়টি এখন আমাদের কাছে স্পষ্ট, দিবালোকের মতো পরিষ্কার এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে এটা স্বীকার করেছে। …বছরের পর বছর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না।…একটা জোটের সঙ্গে কি কেয়ামত পর্যন্ত থাকব?... কোনো অ্যালায়েন্স আপনারা করবেন না, বাস্তবতাও নাই, পারবেনও না।’
বিএনপির পক্ষ থেকে এই বক্তব্যের বিপরীতে কোনো জবাব দেয়া হয়নি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ বিষয়ে তারা কিছুই বলবেন না। সাংবাদিকদের প্রশ্নে এও বলেছেন, কিছু না বলতে চাওয়া তার গণতান্ত্রিক অধিকার।
রংপুরে কাকে প্রার্থী করছে জামায়াত?
আগামী ২৭ ডিসেম্বরের ভোটে মেয়র পদে জাতীয় পার্টির গতবারের বিজয়ী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, আওয়ামী লীগের হোসনে আরা ডালিয়ার মোকাবিলায় মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন রংপুর মহানগর আমির মাহবুবার রহমান বেলাল।
তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন ২৯ নভেম্বর। তবে এখন পর্যন্ত মেয়র পদে জমা পড়েছে ১৩টি আবেদন। তারা আগামী ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে পারবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত ভোটে থাকছে কি না, সেটি নিশ্চিত হতে হলে সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
অতীতের নানা ভোটের পরিসংখ্যানে রংপুর শহরে জাতীয় পার্টির শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো আছে কেবল আওয়ামী লীগ। তবে জামায়াতে ইসলামীও নানা সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পেয়ে আসছে।
২০১২ সালে সিটি করপোরেশনের প্রথম ভোট দলীয় প্রতীকে হয়নি। সেবার আওয়ামী লীগের সমর্থনে প্রার্থী হয়ে জেতেন প্রয়াত নেতা সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। লড়াই হয় জাতীয় পার্টি সমর্থিত মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার সঙ্গে।
ঝন্টু পান ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট, মোস্তফা পান ৭৭ হাজার ৮০৫টি।
২০১৭ সালের দলীয় প্রতীকে দ্বিতীয় নির্বাচনে নৌকার ঝণ্টুকে উড়িয়ে দেন লাঙ্গলের মোস্তফা। আওয়ামী লীগ ভোট পায় ৬২ হাজার ৪০০, জাতীয় পার্টি পায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট।
সেবার বিএনপি নেতা কাওসার জামান বাবলা স্বতন্ত্রের ব্যানারে অংশ নিয়ে ভোট পান ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট। তখন জোটের শরিক জামায়াত ভোটে অংশ না নিয়ে বাবলার পাশে থাকে।
এবারের ভোটে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগে বিভেদ আছে। ঘোষিত প্রার্থীকে মেনে না নিয়ে দুই দলেরই একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
জামায়াত নেতার বক্তব্য পাওয়া সহজ নয়
মনোনয়নপত্র জমা দিলেও জামায়াত নেতা আলী মাহবুবার রহমানের বক্তব্য পাওয়া সহজ নয়। তিনি তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গেই কেবল কথা বলেন। তাদের মাধ্যমে যোগাযোগ করেই বক্তব্য পেয়েছে নিউজবাংলা। যদিও সব জিজ্ঞাসার জবাব মেলেনি।
সেই সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘এটা হলো লোকাল গভর্নমেন্ট, এখানে জনগণের সেবা দেয়া দরকার, উন্নয়নের দরকার। সেই লক্ষ্যে এখানে দলের অন্তর্ভুক্তিটা ক্ষতিকর। যখন দলীয় কোনো প্রার্থী এখানে নির্বাচিত হবেন, সঙ্গত কারণে দলীয় লোকজন সেখানে গিয়ে দাবি দাওয়া করবে, আবদার করবে, চাঁদা চাইবে। তাতে সিটি করপোরেশনের কাজ ব্যহত হবে, দুর্নীতির একটা রাস্তা খুলে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘এজন্য আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী। বিভিন্ন দল মতের সমর্থনে আছি। ব্যানার, পোস্টার, হ্যান্ডবিলে কোথাও দলের উল্লেখ নাই। আমি জনগণের মেয়ের হতে চাই। জনগণের কল্যাণে কাজ করতে চাই।’
এই ভোটে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে দলের সম্মতি আছে কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে বলেছি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলের কোনো প্রশ্ন নাই, দলের কোনো গুরুত্ব নাই, দলের প্রয়োজনও নাই। কারণ, এখানে আইন প্রণয়ন হবে না, সংবিধান রচনা হবে না, মন্ত্রিপরিষদ গঠনও হবে না।’
জামায়াতের মহানগর সেক্রেটারি আনোয়ারুর ইসলাম বলেন, ‘এমনটা না যে তারা (বিএনপি) আমাদেক ভোট করতে কইছে। কারণ, তাদের একটা আদর্শ আমাদের একটা আদর্শ।’
সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতার ভিত্তিতে এই নির্বাচন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আঁতাতের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা দলীয় কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি না। কাজে এখানে কোনো কথাই আসে না যে আদর্শগত বা তাদের সঙ্গে আঁতাত করতে হবে।’
তবে নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন এর রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি ফখরুল আনাম বেঞ্জু মনে করেন, জামায়াত নেতার ভোটে অংশগ্রহণ ইঙ্গিতবাহী। তিনি বলেন, ‘রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি জামায়াতকে উৎসাহিত করল, যেটা বাংলাদেশের জন্য আরেকটা সংকেত বহন করে।
‘বিগত দিনে বিশেষ করে রংপুর শহরে তাদের কার্যক্রম ছিল না। এই ভোটের মাধ্যমে তারা সুসংগঠিত হতে চাইছে যা আগামী দিনে রংপুর অঞ্চলের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।’
বিএনপি কী করবে?
রংপুর সিটির আগের দুটি নির্বাচনে বিএনপি নেতা কাওসার জামান বাবলা অংশ নিলেও এবার তাকে ফেরানোর চেষ্টা করছে দল।
জেলা বিএনপির এক শীর্ষ নেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাবলা নির্বাচন করতে চান স্বতন্ত্রের ব্যানারে। কিন্তু আমরা তাকে না করে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তই আছে।
‘স্বতন্ত্রের ব্যানারে করুক আর যেভাবে করুক, ব্যক্তিটি তো বিএনপি নেতা। তিনি নির্বাচনে অংশ নিলে দল বড় সমালোচনার মধ্যে পড়ে যাবে।’
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামছুজ্জামান সামু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বলেই আসছি তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনো নির্বাচনে যাব না। আমরা এবং আমাদের দল সেই সিদ্ধান্তে আছি। আমরা কেউ এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। কোনো নেতা যদি স্বতন্ত্রের নামে নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে দল তার বিরুদ্ধে কঠিন অ্যাকশনে যাবে।’
বিএনপি ভোটে না এলেও জামায়াত নেতার প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব মাহফুজ উন নবী ডন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। এই সরকারের অধীনে জনগণের ভোটাধিকার নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া জাতীয় বা স্থানীয় কোনো নির্বাচনই এই সরকারের অধীনে যাব না, যাচ্ছি না। জামাত ভোট করছে সে বিষয়ে আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগযোগ নেই, হয়নি। সেটা তাদের বিষয়।’
গত আগস্টে জোট ছাড়ার বিষয়ে জামায়াত আমির যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তারপর রংপুর জামায়াতের এই আচরণে দুই দলের সম্পর্ক ছিন্নের প্রমাণ পাওয়া গেল কি না, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি আমার সংগঠনের বিষয়ে কথা বলতে পারি। অন্য সংগঠনের বিষয়ে কিছু জানি না। ভোট নিয়েও কোনো কথা হয়নি। জোটের বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আছেন বিষয়টি তারাই দেখেন।’
কেন্দ্রীয় বিএনপি কী বলছে
জামায়াত আমিরের জোট ছাড়ার বক্তব্যের পর রংপুরে বিএনপির সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে জামায়াতের প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে নিউজবাংলা কথা বলেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এমন কোনো তথ্য (রংপুরে জামায়াতের প্রার্থী দেয়া) আমার জানা নেই। আর স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ালে তিনি তো আর দলীয় পরিচয় বহন করছে না।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী দলীয় পরিচয় বহন করে না বললেও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় নারায়ণগঞ্জে তৈমূর আলম খন্দকার ও কুমিল্লায় মনিরুল হক সাক্কুকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
বিএনপির সঙ্গে জোট আর নেই বলে জামায়াতের আমিরের বক্তব্যের বিষয়ে নজরুল বলেন, ‘কথাবার্তা টুকটাক সবাই বলেন। আর জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে সেটাতো আপনাদের দাওয়াত দিয়েই জানাব।’