ময়মনসিংহের ভালুকার উথুয়া ইউনিয়নের হাতিবেড় গ্রামে ২০০৪ সালে শুরু হয় দেশের প্রথম বাণিজ্যিক কুমিরের খামার। বিতর্কিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের কারণে দুই বছর মুখ থুবড়ে পড়েছিল খামারের কার্যক্রম।
নতুন মালিকানায় সংকট কাটিয়ে আবারও পুরোদমে চলছে খামারটির কাজ। বর্তমানে খামারটিতে কাজ করছেন ২৮ কর্মকর্তা-কর্মচারী। চাষ হচ্ছে ২ হাজার কুমিরের। কুমির লালন-পালনে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকরা। বেতন-ভাতা বুঝে পেয়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে। বাড়তি আয় করতে পর্যটকদের জন্য খামারটি উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা ভাবছে কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে ‘রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড’ নামের এই খামারটিতে গিয়ে দেখা যায়, আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে পানিতে ঢেউ তুলছে বড় আকারের কুমিরগুলো। রপ্তানিযোগ্য কুমিরকে ডিম ফোটানোর পর থেকে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পুকুরে পরিচর্যা করা হচ্ছে। ছোট কুমিরকে গরু ও মুরগি মাংসের কিমা এবং মুরগির মাথা দেয়া হচ্ছে।
ব্রিডার কুমিরকে বয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ খেতে দেয়া হচ্ছে। কুমির পরিচর্যায় ব্যস্ত দেখা যায় শ্রমিকদের।
শুরুতে মোস্তাক আহমেদ ১৫ একর জমিতে গড়ে তোলেন এই কুমিরের খামার। আর ৩৬ শতাংশ মালিকানা নিয়ে সাথে ছিলেন মেজবাহুল হক। ২০১২ সালে খামারের শেয়ার ছেড়ে দিলে মালিকানায় চলে আসেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী পি কে হালদার। এরপর থেকে এ খামার দেখিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেন বিপুল পরিমাণ ঋণ।
২০২০ সালে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় খামারের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। হুমকিতে পড়ে খামারে কুমিরের পরিচর্যা। ঋণ খেলাপ এবং পি কে হালদার ইস্যুতে দুই বছর যাবৎ মুখ থুবড়ে পড়ে কুমির খামার।
আদালতের নির্দেশে চলতি বছরের মার্চে খামার পরিচালনায় গঠন হয় ছয় সদস্যের পর্ষদ। এতে পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন ড. নাঈম আহম্মেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কুমির বিশেষজ্ঞ এনাম হক। এ ছাড়া পরিচালক পদে দায়িত্বরতরা হলেন রেজাউল সিকদার, ড. মো. রফিকুল আলম, ফখরুদ্দিন আহম্মেদ এবং শেখ মো. আব্দুর রশিদ।
এনাম হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই খামারের সকল সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছি। কুমিরগুলোকে যত্ন সহকারে প্রয়োজনীয় খাদ্য দিয়ে লালন-পালন করা হচ্ছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন। এ খামারটি ঘিরে স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেহেতু সরকারের কালো তালিকাভুক্ত কোম্পানি, তাই আমরা সরকারের কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। কুমিরের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যা বিক্রি হয় না। ফলে আমরা আমাদের গতিতে এগুচ্ছি।’
বাড়তি আয়ের লক্ষ্যে খামার ঘিরে শিগগির ট্যুরিজম ব্যবস্থা চালু করা হবে উল্লেখ করে এনাম হক আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছি, দেখেছি কুমির চাষকে ঘিরে তাদের ট্যুরিজম বাণিজ্য অনেক। আমাদেরও টার্গেট হচ্ছে ট্যুরিজম চালু করা। খুব দ্রুতই এটি বাস্তবায়ন করা হবে।’
রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপক ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাত্র ৭৪টি কুমির নিয়ে খামারটি যাত্রা শুরু করে। ২০১০ সালে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৬৭টি হিমায়িত কুমির রপ্তানির মধ্য দিয়ে এর বাণিজ্যিক রপ্তানি শুরু।’
২০১৯ সাল পর্যন্ত এই খামার থেকে কুমির রপ্তানি হয়েছে। পাঁচবারে জাপানে রপ্তানি করা হয়েছে কুমিরের ১ হাজার ৫০৭টি চামড়া। ২০২০ সালের অক্টোবরে কোম্পানির অ্যাকাউন্ট জব্দ হলে খাবারের স্বাভাবিক জোগান বন্ধ হয়ে যায়।
ফলে কুমিরগুলোকে খাবার দেয়া হয় স্বাভাবিকের চেয়ে কম। প্রজনন ক্ষমতা ও শক্তি হারিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্বল হয় কুমিরগুলো।
তিনি বলেন, ‘এতদিন নিজেরাও বেতনভাতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। নতুন পরিচালনা পর্ষদ আসার পর ২৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংকট কেটে গেছে। বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে ২ হাজার কুমির রয়েছে। এই বছর খামারে উৎপাদিত কুমিরের ডিম থেকে প্রায় ২০০ মতো বাচ্চা পাওয়া গেছে।’
ডা. আবু সাইম মোহাম্মদ আরিফ আরও বলেন, ‘কুমিরের খাবারের জন্য ফার্মের নিজস্ব ব্রয়লার মুরগির খামার, মাছের পুকুর, ডিম ফোটানোর অত্যাধুনিক ইনকিউবেটর, কুমিরের বাচ্চার বিশেষভাবে তৈরি হ্যাচারি, পৃথক শেড, চামড়া প্রসেসিং জোন, চামড়া মজুদ রাখার জন্য চিলিং রুম, ব্রিডার পুকুর রয়েছে এ খামারে। বিশ্ব বাজারে কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত চড়া দামে বিক্রি হয়।
‘ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পরিকল্পনা মাফিক খামারটি পরিচালনা করতে পারলে ব্যাপক সাফল্য আসবে।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ কে এম রুহুল আমিন বলেন, ‘দেশে কুমির চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার কুমির চাষীদের নানাভাবে উৎসাহিত করছে। কেউ শর্ত মেনে আবেদন করলে পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেয়া হবে।’