২৪ নভেম্বর এলেই আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে বসবাসরত তাজরীন অগ্নিকাণ্ডে আহত শ্রমিকরা বরাবরের মতো সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরেন তাদের বিভীষিকাময় স্মৃতির কথা। ভয়াল সেই দিনের কথা বলতে গিয়ে আহত অনেকের কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।
২০১২ সালের এই দিনে নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ১১২ শ্রমিক। আহত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন আরও দুই শতাধিক।
আহত শ্রমিকসহ নিহতদের স্বজনদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার দাবি জানিয়েছেন তারা। এ সময় তারা তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে দোষী উল্লেখ করে তার দ্রুত শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন।
তাজরীনের আহত শ্রমিক নাছিমা আক্তার বলেন, ‘ওই দিন আমরা ওয়ালমার্ট বায়ারের শিপমেন্টের জন্য কাজ করতেছিলাম। শিপমেন্টে যাওয়ার পর পৌনে ৭টার দিকে হঠাৎ করেই হালকা করে ফায়ার অ্যালার্ম বাজল। পরে পোলাপান ছোটাছুটি শুরু করছে বের হওয়ার জন্য। তখন ফ্যাক্টরির ম্যানেজার বকাঝকা দিলেন। গালি দিয়া বললেন যে, একটু হুজুক পাইলেই দৌড়াদৌড়ি করে। মেকানিকসরা কাজ করার সময় হয়তো অ্যালার্মে চাপ পড়ছে।
‘এই বইলা সবাইরে ধমক দিয়া বসায় দিল। পরে চারদিক থাইকা খালি আগুন আর আগুন, আর আমরা বাইর হইতে পারি নাই। পরে কোনো মতে তিনতলার স্যাম্পল রুমে আসি। তখন জানালা ভাইঙা আমরা সবাই লাফ দিয়া নিচে পড়ি। পইড়া আমার বাম হাত ভাইঙা যায়। ডান হাতের মাংস কাইটা পইড়া যায়। মেরুদণ্ড ও কাঁধে আঘাত পাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার পর থাইকা তিনটা ছেলে-মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি নিশ্চিন্তপুরে। থাকার মতো গ্রামে কোনো ভিটামাটিও নাই। সরকার একবারও আমাদের দিকে তাকায় না। বারবার আমরা অনুরোধ করি, তাজরীনের আহত শ্রমিক যাদের বাড়িঘর নাই, তাদের যেন একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষতিপূরণও দেয় না, চিকিৎসা ও থাকার ব্যবস্থাও করে না। আর যে মালিক ষড়যন্ত্র করে আগুন লাগালো তারও আইজ পর্যন্ত বিচার বা শাস্তি হলো না।’
তাজরীনের আরেক শ্রমিক সুইং অপারেটর সবিতা রানী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তো আর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ১০ বছর যাবৎ দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবার কাছে দ্বারে দ্বারে বহুত ঘুরছি। কিন্তু আমরা আজও পর্যন্ত কারও কাছে ন্যায্য বিচার পাই নাই।
‘আজ ১০ বছর হইতেছে, আমরা কিছু করতে পারছি না। আমরা ধুঁকে ধুঁকে মরছি। যারা তো মারা গেছে তারা তো মরছেই। আমরা তো বাঁইচাও মরছি। অনেকে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। এতদিনে আমরা কেন বিচার পাচ্ছি না। আমরা কী তাজরীনে কাজ করতে আসছিলাম এটাই ভোগ করার জন্য?' প্রশ্ন তোলেন সবিতা রানী।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাভার-আশুলিয়া আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি খাইরুল মামুন মিন্টু বলেন, ‘তাজরীন গার্মেন্টেসে অগ্নিকাণ্ডের ১০ বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু আমরা দেখছি, এই ঘটনার ১০ বছর পার হওয়ার পরও তাজরীনে আহত এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যরা কেউই ক্ষতিপূরণ পান নাই। এমনকি দোষী গার্মেন্টস মালিক দেলোয়ার হোসেনের বিচারও করা হয় নাই।
‘এটা যে পরিকল্পিত হত্যা ছিল, এটি পরিষ্কার। কারণ সে সময় তাজরীনের মালিক তার গাড়িটা পাশের ভবনে রেখেছিল এবং তাদের ফ্যাক্টরিতে মাল আনা-নেওয়ার গাড়িগুলোও বাইরে ছিল। তার মানে এটা প্রমাণিত যে, মালিকপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবেই শ্রমিকদের পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এতদিন পরও দেলোয়ারের কোন শাস্তি হয় নাই,’ যোগ করেন এই শ্রমিক নেতা।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই দোষী দেলোয়ার হোসেনের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। আহত ও নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের পুনর্বাসনের জন্য তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটায় সরকারিভাবে তাদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক।