সর্বোচ্চ দামে এখন বিক্রি হচ্ছে লবণ। ফলে মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই মাঠে নেমে গেছেন লবণ চাষিরা। প্রস্তুতি চলছে, কোথাও আবার উৎপাদনও হচ্ছে। আমদানী বন্ধ থাকলেই ন্যায্য পাবেন চাষিরা, লবণ শিল্পের সুদিন ফিরবে– সে আশায় বুক বেঁধেছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সিন্ডিকেটের চক্রান্তে পা না দিয়ে আমদানি বন্ধ রাখলে চাষিরা দীর্ঘদিনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। অন্যদিকে বিসিক বলছে, চাষিরা আগাম মাঠে নামায় এবার লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে উৎপাদন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিকের) তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের লবণের চাহিদার ৮০ ভাগই কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে মেটানো হয়ে থাকে। এ মৌসুমে কক্সবাজার সদর, ঈদগাও, চকরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফ ও বাঁশখালীর ৩৮ হাজার চাষি মাঠে নেমে গেছেন পুরো দমে। করছেন মাঠ প্রস্তুত।
এবার প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার টন।
লবণ চাষ যেসব জায়গায় হয়, সেখানে অন্য কোনো ফসল হয় না। ফলে টার্গেট পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বিসিক। বর্তমানে ১ লাখ ৮০ হাজার টন লবণ মাঠে মজুদ রয়েছে। এর ফলে লবণ আমদানি করেনি সরকার। ইতোমধ্যে চলতি মৌসুমে কুতুবদিয়ায় ১০০ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে।
চাষিরা বলছেন, মণ প্রতি লবণ উৎপাদনে খরচ হয় ২৫০ টাকা, অথচ বাজারমূল্য এখন ৫০০ থেকে ৫৫০টাকা। তাই আগেই চাষে নেমেছেন তারা।
সদর উপজেলার চৌফলদন্ডীর চাষি মোহাম্মদ তৈয়ব। লবণ চাষে তার অভিজ্ঞতা দুই যুগের বেশি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লবণ চাষের ভরা মৌসুম হচ্ছে ফাল্গুন-চৈত্র মাস। আরও চার মাস লবণ উৎপাদন হয় ভালো। রোদ থাকলে চৈত্র মাসে এক কানিতে ১২০ মণ পর্যন্ত লবণ উৎপাদন হয়। কিন্তু লবণের ন্যায্য মূল্য নিয়ে সংশয় কাটে না। এ কারণে অনেকে লবণ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন চাষ করার কারণে আমরা ছেড়ে যেতে পারছি না। আশা রাখছি এবার ভালো উৎপাদন ও ন্যায্য মূল্য পাব।’
জমির মালিকদের উপর ক্ষোভ জানিয়ে কুতুবদিয়ার চাষী আজিম উদ্দিন বলেন, ‘তাদের কাছে জিম্মি লবণচাষিরা। বছর বছর লবণ চাষের জমির ইজারা মূল্য বাড়ানো হচ্ছে, এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে অন্যান্য খরচ। এতে লবণের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে লবণের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় প্রান্তিক চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
মহেশখালীর লবণ চাষী আব্দু মোনাফ বলেন, ‘গেল কয়েক বছর ধরে বিদেশি লবণ আমদানির অজুহাতে ন্যায্য মূল্য বঞ্চিত আমরা। তাই অনেকে এ মৌসুমে লবণ চাষে আসেনি। যারা এসেছে, তারাও ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন। আবাহাওয়ার সমস্যা তো থাকবেই।’
এ ছাড়া লবণ চাষকে কেন্দ্র করে ইসলামপুরে গড়ে উঠেছে ৪০টি রিফাইনারি কারখানা। এর মধ্যে ৩০-৩৫টি কারখানা এখন সচল আছে। একটি রিফাইনারি কারখানা চালু করতে হলে সপ্তাহে কমপক্ষে ৭০ টন লবণ প্রয়োজন। লবণ রিফাইনারিতে প্রতিটি কারখানায় ৩০-৪০ জন শ্রমিক কাজ করে। তাদের কাজ দিতে হলে সপ্তাহে ৭০ টন ‘র’ লবণ প্রয়োজন বলে জানান মালিকরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত মৌসুমের ১ লাখ ৮০ হাজার টন লবণ মাঠে মজুদ আছে। আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকলে এবার চাষীরা বেশি উপকৃত হবেন, আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ লবণ চাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘লবণ আমদানি চক্র সুকৌশলে সোডিয়াম সালফেট (মিল-কারখানায় ব্যবহৃত লবণ) নাম দিয়ে দেশে অহরহ নিয়ে আসছে সোডিয়াম ক্লোরাইড তথা খাদ্যলবণ। এসব লবণ তারা চীন থেকে আমদানি করে সরাসরি বাজারজাত করছেন। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। আমদানিনির্ভর কিছু লবণ মিল মালিক সবসময়ই লবণ আমদানির জন্য অনুমতি পেয়ে থাকেন। তারা চান দেশীয় লবণ শিল্প চিরতরে বন্ধ হয়ে যাক। বিপরীতে সুফল হিসেবে তারা দেশের টাকা লুটেপুটে খাক।’
তিনি বলেন, ‘গত মৌসুমের ১ লাখ ৮০ হাজার টন লবণ মাঠে মজুদ আছে। লবণ আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকলে এ মৌসুমে ভাল দাম পাব। যার ফলে বাড়বে চাষির সংখ্যা। বেড়ে যাবে লবণ উৎপাদনও।’
কক্সবাজার বিসিকের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া নিউজবাংলাকে জানান, প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ চাষের সম্ভাবনা দেখছেন তারা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে কক্সবাজারের লবণ দিয়ে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে আশা করছেন তিনি। এবারের লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্টিক টন, যা পূরণে মাঠ পর্যায়ের চাষিদের নানা সহযোগিতা দিতে জবে বলে জানান বিসিকের এই কর্মকর্তা।
মহেশখালী কুতুবদিয়া আসনের সাংসদ আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ‘একটি চক্র লবণ শিল্পকে ধ্বংস করে ফায়দা লুটতে চায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, লবণ চাষিরা যাতে ন্যায্যমূল্য পায়, তা নিশ্চিত করবেন। তিনি যা বলেন, তা বাস্তবায়ন করেন। লবণ চাষিরা প্রধানমন্ত্রীর উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছে বিধায় এখন সুফল পাচ্ছে।’
লবণ শিল্পের ইতিহাস বলছে, পঞ্চদশ শতাব্দীতে কক্সবাজার জেলায় লবণ চাষ শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে লবণ ব্যবসা বিকাশ লাভ করলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ সরকার এ দেশে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধ করে ইংল্যান্ড থেকে লবণ আমদানি শুরু করে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে উপকূলীয় জমি পরিষ্কার করে সাগরের পানি সূর্যে ও তাপে বাষ্পীভূত করার মাধ্যমে এক ব্যক্তি লবণ চাষ শুরু করেন।
১৯৪৭ সালে কক্সবাজার সদর উপজেলার গোমাতলী মৌজাতে এক ব্যক্তি ১২০ একর জমি দীর্ঘ মেয়াদি বন্দোবস্ত নিয়ে লবণ চাষ শুরু করেন। সে থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লবণ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়।