শুরুটা সেই ২০০০ সালে। ২২ বছর ধরে গাছ রোপণ করেই যাচ্ছেন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দের ভদ্রঘাট গ্রামের মাহবুবুল ইসলাম পলাশ। পেশায় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা। গড়ে তুলেছেন বিরল প্রজাতির গাছের এক বাগান, যাতে ৩৪৫ প্রজাতির গাছের সংখ্যা এখন প্রায় পাঁচ হাজার।
উপকূল ছাড়া জন্মে না, পাহাড় ছাড়া দেখা মেলে না- এসব গাছও আছে তার সেই বাগানে। ভিন্ন পরিবেশে গাছগুলো ঠিকই বেড়ে উঠছে। তিনি চেষ্টা করছেন গাছগুলো ছড়িয়ে দিতে। চাইছেন অন্যরাও যেন এভাবে এগিয়ে আসে।
বৃক্ষপ্রেম পলাশের জন্য এনে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও। পরিবেশ রক্ষা ও কৃষিতে অনন্য অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার-১৪২৬ জুটেছে তার।
বাংলাদেশে যেসব গাছ আছে, তার মধ্যে তরুণ ব্যাংকারের বাগানে নেই, এমনটি খুঁজে পাওয়া কঠিন। উপকূলে লোনাজলের কাদামাটিতে জন্মানো সুন্দরী গাছও যমুনাতীরের সেই বাগানে তরতর করে বেড়ে উঠেছে।
শুধু তা-ই নয়, পাহাড়ের রুক্ষ, ঊষর মাটি ছাড়া টেকে না- এমন গাছও যত্নে বড় হচ্ছে পলাশের বাগানে।
শুরুটা যেভাবে
বিশ শতকের শুরুতে সারা দেশে ইউক্যালিপটাসগাছ রোপণের হিড়িক পড়ে। তখন পলাশ খোঁজখবর নিয়ে জানেন, ই-গাছ পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। গাছটি প্রচুর পানি শোষণ করে, পাখি বসে না এর ডালে। তখন তিনি বাড়ির আশপাশে লাগালেন চাপালিশ, চিত্রাশী ও বান্দরহুলা গাছ।
সেই থেকে শুরু। দশম শ্রেণির ছাত্র হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ফলদ গাছের পাশাপাশি বিরল প্রজাতির গাছের চারাও রোপণ করতে থাকেন।
২০০৭ সালে এক বন কর্মকর্তার কাছ থেকে ৭০০ টাকায় ৭০০টি সেগুন গাছের চারা কেনেন। এরপর বৃক্ষ রোপণের নেশা পেয়ে বসে। হৈমন্তি, ঝুমকোবাদি, নীল পারুল, কন্যারি, নীল মণিলতা থেকে শুরু করে সুন্দরবনের সুন্দরী, গোলপাতায় সমৃদ্ধ হতে থাকে তার বাগান।
পলাশ নিউজবাংলাকে জানান, তার সুন্দরীগাছের নেশার কথা। গাছের চারার জন্য তখন নানা জায়গায় ধরনা দিচ্ছিলেন। সবাই তাকে যেতে বলেন সুন্দরবনে। কিন্তু সেখানে আর যাওয়া হয় না। কিন্তু তিনি খুঁজে পান ম্যানগ্রোভ বনের এলাকার বাসিন্দা খুলনার দাকোপের এক শিক্ষার্থীকে। অনুরোধ করেন তাকে চারা জোগাড় করে দেয়ার।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার আগে সেই ছাত্র তাকে সুন্দরবন থেকে তিনটি সুন্দরীর চারা এনে দেন। কিন্তু বাঁচেনি একটিও। পরে গাছের বীজ এনে দেন তিনি। বহু সাধনায় সেই বীজ থেকে ফোটে সাতটি চারা। সেই চারাগাছ এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তার বাগানে।
বাড়ির বারান্দায় চারটির পাশাপাশি সমতলেও ৯টি সুন্দরীর চারা রোপণ করেছেন তিনি। এই গাছকে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে তুলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে।
পলাশ চাকরি করেন রাজশাহীতে। সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার বাগানের নেশায় ছুটে আসেন সিরাজগঞ্জে। ব্যস্ত সময় কাটান প্রিয় গাছের পরিচর্যায়। তার অবর্তমানে দেখভালের কাজটি করেন তার মা। তাকে সহায়তার জন্য রাখা হয়েছে শ্রমিক।
যেসব গাছ আছে বাগানে
নিউজবাংলাকে পলাশ বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে এক একর জমিতে আমি গড়ে তুলেছি শখের বাগান। ৩৪৫ প্রজাতির পাঁচ হাজারের বেশি ফল, ফুল, ঔষধি, কাঠজাতীয় এবং বনের নানা প্রজাতির গাছ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৫৮টি প্রজাতি মহাবিপন্ন।
‘এখন আমার বাগানে সুন্দরবনের নোনাপানির সুন্দরীসহ আরও ১৮ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এ ছাড়া বিরল ও মহাবিপন্ন ৮৮ প্রজাতির বিভিন্ন গাছ ও বিরল প্রজাতির ৩২ ধরনের ফুলগাছ রয়েছে।’
সুন্দরী ছাড়াও সুন্দরবনের নোনাপানির গাছের মধ্যে রয়েছে গোলপাতা, কৃপা, খোলসা, কাঁকড়া, পশুর, উড়া, গড়ান, পাইন ও কেওড়া।
রয়েছে তেলিগর্জন, ধলিগর্জন ও শ্বেতগর্জনও। এদের মধ্যে শ্বেতগর্জন উপকূলীয় এলাকা ছাড়া হয় না।
বাগানে আছে গুটগুটিয়া, মাল্লাম, বান্দরহোলা, কুসুম, মণিরাজ, কুঠিশর, কাটাবাজনা, ডোলসমুদ্র, চাপালিশ, লোহা ও তেলসুর।
সিঁথিতে দেয়া সিঁদুর তৈরি হয় যে গাছ থেকে, সেটিও আছে এই বাগানে, রয়েছে বাহারি পানমসলা গাছও।
বুদ্ধ নারকেলগাছও আছে সংগ্রহে। এই ফল পাখি-মানুষ সবাই খায়। রয়েছে গলায় দেয়া যজ্ঞপ্রবীত তৈরির রুদ্রলক্ষ গাছ। দুর্লভ গাছ ঢাকিজাম, উড়িয়াম, সিভিট, মাইলাম, ভুঁইকদম, কন্যারি, হুলদু, সিদাজারুল, রক্তন, রাতাতুন, দুদকুরুজ, বিহদারুল, ধূপ, লোহা ও লুকলুকি দেখতে চাইলেও যেতে হবে বাগানটিতে।
এর মধ্যে সিভিটগাছের ফল কাকাতুয়া, ময়না ও টিয়ার পছন্দ। বাগানে এখন দেখা মেলে এসব পাখির। তারা বাসা তৈরি করে বাচ্চাও উৎপাদন করছে।
জায়গার সংকটের কারণে বাগান ছাড়াও সিরাজগঞ্জে যমুনা পারে একই গাছের চারা রোপণ করে দিয়েছেন পলাশ। পাখির নিরাপদ বাসস্থান তৈরি করে দিতে গাছে গাছে ঝোলানো হয়েছে মাটির হাঁড়ি ও ঝুড়ি।
বেশ কিছু ফুলের প্রজাতিও সংরক্ষণ করছেন পলাশ। সেগুলো হলো: ঝুমকোবাদি, নীল পারুল, কন্যারি ও নীল মণিলতা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পলাশ চাইছেন তার বাগানটি ধীরে ধীরে দুর্লভ জাতের মাতৃগাছে রূপান্তর করে ফেলবেন। তিনি বলেন, ‘একসময় আমি থাকব না। আমার বাগান থাকবে। যারা এ ধরনের গাছ তৈরি করতে চান, তারা আমার বাগান থেকে বীজ বা চারা নিতে পারবেন।’
বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে এবং বৃক্ষরোপণে অনেক মানুষের আগ্রহ তৈরিতেও কাজ করছেন পলাশ। এলাকায় মেয়েশিশুর জন্ম উদযাপন করেন তিনি বৃক্ষরোপণের মাধ্যমেই।
পৃথিবীতে মেয়ে আগমনের খবর পেলেই উন্নত কাঠজাতীয় গাছের চারা নিয়ে তিনি ছুটে যান সেই বাড়িতে। নিজের হাতে সেটি রোপণ করে আসেন। পরিবারের সদস্যদের বোঝান, মেয়েরা কোনো অংশেই কম নয় ছেলেদের থেকে। তাই ছেলেমেয়ের পার্থক্য খোঁজার দরকার নেই।