১৯৯৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঘোষণা করেন বিচারক। ফাঁসির এ রায় মানতে না পেরে রাজপথে নেমে আসেন তার ভক্তকুল। পাড়া-মহল্লা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজপথ, সবখানে তখন একটাই স্লোগান, ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।’ পরিস্থিতি সামাল দিতে নামানো হয় দাঙ্গা পুলিশ।
যে মানুষটির জন্য এত আন্দোলন তিনি কিন্তু বাস্তব নন। ওই সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) প্রচারিত একটি ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ এর একজন চরিত্র তিনি। কিন্তু নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের কল্পনার সেই চরিত্র ছাপিয়ে বাকের যেন হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের একজন।
এর থেকেই অনুমান করা যায়, ব্যক্তিজীবনে টেলিভিশন কী পরিমাণ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। দেশে সেই সময় মানুষের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল বিটিভি। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরবর্তী কয়েক দশকে দেশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশন যুক্ত হয়েছে সম্প্রচারের তালিকায়। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে টেলিভিশনের সংখ্যা ৩৬টি।
১৯২৬ সালের ২১ নভেম্বর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন লগি বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কার করেন। আর এটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৪০ সাল থেকে। এরপর থেকে গণমানুষের মাধ্যম হিসেবেই পরিচিতি পেয়ে আসছে এই যন্ত্রটি। ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ ২১ নভেম্বরকে বিশ্ব টেলিভিশন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর থেকে। সেই সময় সাদা-কালো রঙে সম্প্রচার হতো। ১৯৮০ থেকে শুরু হয় বিটিভির রঙিন সম্প্রচার।
কালের পরিক্রমায় যুগের উৎকর্ষতায় বিটিভির প্রচারের ধরনেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে শুধু টেরেস্ট্রিয়াল মাধ্যমে বিটিভির প্রচার হতো, এখন স্যাটেলাইট বা কেবল চ্যানেলের মাধ্যমেও প্রচার হচ্ছে। আগে বিটিভির চ্যানেল সংখ্যা ছিল একটি। এখন বিটিভ ওয়ার্ল্ড, সংসদ টেলিভিশন ও বিটিভি চট্টগ্রাম নামে আরও তিনটি চ্যানেল রয়েছে বিটিভির। তবে দেশি কেবল চ্যানেলগুলোর দাপটে অনেকটাই কোণঠাসা হতে হয়েছে বিটিভিকে।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেলটির বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে বিটিভির অনুষ্ঠান ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক জগদীশ চন্দ্র এষ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমত, আমরা প্রযুক্তিগত জায়গার কথা যদি বলি, তাহলে আমাদের ডিজিটাইজেশন ও অটোমেশনের কাজ চলছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিটিভি ডিজিটালের মধ্যে হয়ে গেছে। বিটিভির যে ন্যাশনাল চ্যানেলটা আছে, এটা কিন্তু এখন এসডিতে সম্প্রচার হয়।
‘আমাদের যে টেরেস্ট্রিয়াল সম্প্রচার, সেটারও ডিজিটাইজেশনের কাজ চলছে। আমাদের স্টুডিওসহ অন্যান্য যে ডিভাইসগুলো এগুলোতেও কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। আমরা ভার্চুয়াল স্টুডিও ব্যবহার করছি, আমাদের লাইভ অনুষ্ঠান হচ্ছে। এখানে আমরা টু-ওয়ে কানেক্টিভিটিসহ অন্য ব্যবস্থাগুলো করছি। শিগগিরই আরও পরিবর্তন আনতে আমাদের কাজ চলছে, সেগুলো আমরা সময়ের সঙ্গে করে ফেলব। আমাদের চট্টগ্রাম কেন্দ্রেরও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখানে নতুন টাওয়ার হয়েছে, নতুন ভবনও হবে।’
তিনি বলেন, ‘কন্টেন্টের জায়গায় যদি আসেন দেখবেন, বিটিভি এখন আগের মতো ট্র্যাডিশনাল জায়গায় নেই। মানুষের যে রুচি ও চিন্তার পরিবর্তন, সেটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা একটি স্লোগান সামনে এনেছি: 'সমস্যা আপনার কথা বলবে বাংলাদেশ টেলিভিশন'। আমরা মানুষের সমস্যা, দুর্ভোগ বিটিভিতে নিয়ে এসেছি। এগুলো নিয়ে টকশো হচ্ছে। স্ক্রিনেও কিন্তু আগের চেয়ে পরিবর্তন এসেছে।
‘বিটিভি এবং বিটিভি ওয়ার্ল্ডে এখন একই কনটেন্ট প্রচারিত হয়। আমরা খুব দ্রুতই বিটিভি ওয়ার্ল্ডকে আলাদা করে ফেলব। সেখানে শুধু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান দেখানো হবে। আমরা মনে করি, এটা দেশের প্রথম চ্যানেল হবে, যেখানে শুধু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে। ছয়টি বিভাগীয় শহরে ছয়টি আলাদা চ্যানেল হবে। এটা নিয়ে চীনের সঙ্গে আমাদের চুক্তিও হয়েছে। সেটার কাজও চলমান আছে। কোভিডের কারণে কাজটা কিছুটা পিছিয়ে গেছে। এটা ছাড়াও আমরা একটি চ্যানেল করব, সেটা হবে শিক্ষা ও কৃষি চ্যানেল। সেটার কাজও চলমান আছে।’
বিটিভিতে সরকারি ভাষ্য যতটা প্রচার হয় বিরোধীদের বক্তব্য তেমন একটা প্রচার করা হয় না। এ কারণে একমাত্র রাষ্ট্রীয় এ টেলিভিশনটিকে কটু মন্তব্যের মধ্যেও পড়তে হয়। অবশ্য এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের মতের পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করছেন টেলিভিশনটির এই কর্মকর্তা।
জগদীশ চন্দ্র বলেন, ‘একটি বিষয় হলো, বিটিভি একটি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। এটি কোনো দলের না। রাষ্ট্রকে এটি রিপ্রেজেন্ট করে। সরকার যেহেতু রাষ্ট্র চালায় স্বাভাবিকভাবেই যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের ডেভেলপমেন্ট, তাদের দৃষ্টিভঙ্গির একটি রিফ্লেকশন থাকে। এটি শুধু বাংলাদেশ না, সব জায়গায়ই থাকে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে বিটিভিতে বিরোধী দলের খবর কেন দেখানো হয় না। সেটা হলো এটা রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, নীতিনির্ধারণের ব্যাপার। সেখান থেকে যদি সিদ্ধান্ত হয় তাহলে বিটিভি দেখাবে।
‘কিন্তু আমরা যেটাকে গুরুত্ব দিয়েছি সেটা হলো মানুষের সমস্যা, মানুষ যেগুলো ফেস করছে, আমরা সেগুলো তুলে ধরছি। বিটিভিতে এখন আমরা যেসব সমস্যা তুলে ধরছি, সেখানে সমালোচনা হচ্ছে, সেটা আমরা গ্রহণ করছি। বিটিভিতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে সবাই কিন্তু কথা বলছে। এই কমিউনিকেশন শুরু হয়েছে, অনেক সমস্যাও কিন্তু এর মাধ্যমে সমাধান হয়েছে। কিন্তু এটা তো এক দিনে হয় না, একটা ট্র্যাডিশন ভেঙে সামনে নিয়ে যাওয়া। এটা আমরা শুরু করেছি আর এতে ভালো সাড়াও পাচ্ছি। মানুষ বলছে বিটিভিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে।’
দীর্ঘ সময়েও দর্শক সংখ্যা কত তা বের করতে পারেনি বিটিভি। জগদীশ চন্দ্র বলেন, ‘দর্শক সংখ্যার কোনো জরিপ নেই। তবে আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছি, এটা আমরা করব। তবে আমরা যেটা টের পাই, অনেকে বলে বিটিভি মানুষ দেখে না।
‘কিন্তু আমরা যখন কোনো ভুল করি, একটি স্ক্রলে বানান ভুল হয়, তখন এটা কিন্তু নোটিশ হয়। সেটা দেখে আমরা বুঝি যে বিটিভি মানুষ দেখে।’