ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গি পালিয়ে যেতে পারলেও তাদের সঙ্গে থাকা আরও দুজন পালাতে পারেননি। পালাতে ব্যর্থ দুই জঙ্গি হলেন মো. আরাফাত ও মো. সবুর।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে হাজির করে হাজতখানায় নেয়ার সময় চারজনের মধ্যে দুইজনকে ছিনিয়ে নেয়া হয়।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের প্রধান ফটকের সামনে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল দুটি মোটরসাইকেল।
ফটকের কাছে পৌঁছাতেই হাতকড়া পরা চার জঙ্গি পুলিশ সদস্যদের মারধর শুরু করেন। এ সময় ব্যবহার করা হয় পিপার স্প্রে। একপর্যায়ে দুই জঙ্গি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তারা হলেন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফীন দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির সাংবাদিকদের বলেন, মোহাম্মদপুর থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা একটি মামলার রোববার শুনানি ছিল। সেই মামলার আসামি ২০ জন, এর মধ্যে ৬ জন পলাতক, ১২ জন জেলহাজতে ও ২ জন জামিনে ছিলেন।
ওই মামলার শুনানি শেষে বের হওয়ার পর মূল ফটকের সামনে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়।
আদালতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, মোহাম্মদপুর থানায় করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলাটিতে রোববার অভিযোগ গঠন হয়। এ জন্য জামিনে থাকা দুই আসামি হাজিরা দেন আদালতে। আর কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে ১২ আসামিকে আনা হয়।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান শুনানি শেষে ২০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এরপর আসামিদের আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোর্টের শুনানি শেষে প্রথমে চারজনকে নিচে নামিয়ে আনা হয়। দুটি হাতকড়া দিয়ে দুই-দুইজনকে আটকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাকি আসামিরা তখন ওপরে ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘চারজনের মধ্যে মইনুল হাসান ও আবু সিদ্দিককে জঙ্গিরা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তবে মো. আরাফাত ও মো. সবুরকে নিতে পারেনি। জঙ্গিরা পিপার স্প্রে ব্যবহার করে। এতে একজন সিকিউরিটি গার্ড, একজন পুলিশ সদস্যসহ কয়েকজন সাধারণ মানুষ আক্রন্ত হন।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আদালতের মূল ফটকের কাছে পোঁছানোমাত্র কয়েকজন দুর্বৃত্ত পুলিশের চোখে পিপার স্প্রে মেরে হাতকড়া পরানো চার আসামিকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ সদস্যদের মারধরও করা হয়। এতে আহত হন পুলিশ সদস্য নুরে আজাদ। এরপর দুই আসামি একটি মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যান, যেটির চালক ছিলেন আরেকজন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মো. গোলাম ছারোয়ার খান জাকির বলেন, ছিনিয়ে নেয়া দুই জঙ্গিই দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি। সাকিবুর অভিজিৎ হত্যা মামলারও মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি। তবে মোহাম্মদপুর থানায় করা আরেকটি মামলায় শুনানির জন্য তাদের আদালতে আনা হয়েছিল।
জঙ্গিদের মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যাওয়ার একটি সিসিটিভি ফুটেজ পেয়েছে নিউজবাংলা। এতে দেখা যায়, ১ নম্বর রঘুনাথ দাস লেনের রায় সাহেবের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে লাল রঙের একটি বাইকে তিনজন পালিয়ে যান। তাদের পিছু পিছু আরও কয়েক যুবক দৌড়াচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের হাতে হেলমেট, দুইজনের হাতে ব্যাগ ও দুইজন খালি হাতে ছিলেন।
আদালত প্রাঙ্গণের ভেতরের বই বিক্রেতা মো. নিজাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই একজন মেয়ে আমার দোকানের দিকে এসে বলে একটু পানি দেন। সে অনেক কাশছিল। তার সঙ্গে একটা বাচ্চা ছিল, সেই বাচ্চার মুখ আটকে রেখেছিল ওই মেয়ে।
‘মেয়েটি বারবার বলছিল, একটু পানি দেন স্প্রে মারছে। আমি এটা শুনে ঘটনাস্থলে দৌড়ে গেছি। সেখানে গিয়ে দেখি অনেক লোক গলি দিয়ে দৌড়াচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরে দেখলাম পুলিশ দুইজনকে ধরে নিয়ে আসছে।’
নিজাম বলেন, ‘গেটে যে সিকিউরিটি ছিলেন তাকে স্প্রে মারছে। আর যে পুলিশ তাদের নিয়ে যাচ্ছিল তাকে মেরে মুখ দিয়ে রক্ত বের করে দিয়ে হ্যান্ডকাপ পরেই দুই আসামি পালিয়ে গেছে।’
১ নম্বর রঘুনাথ দাস লেনের অ্যাডভোকেট মো. লুৎফর রহমানের চেম্বারের শিক্ষানবিশ আইনজীবী রাব্বুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আনুমানিক দুপুর ১২টার দিকে হঠাৎ করে দেখি কয়েকজন ছেলে দৌড়ে পালাচ্ছে। আমরা প্রথমে ভাবছি মোবাইল চুরি করে দৌড়াচ্ছে। পরে দেখি পেছনে পেছনে পুলিশ দৌড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে এক পুলিশের মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা একটি অ্যান্টিকাটার ড্রেনে ফেলে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ সেটা জব্দ করে।’
ওই এলাকার কারকুন বাড়ি মসজিদের সামনে ভিক্ষা করছিলেন জোহরা বেগম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকজনকে দেখি দৌড়ায় পালাচ্ছে। কিছু সময় পর দুজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। বাকিরা মসজিদের সামনের রাস্তা দিয়ে পালিয়ে গেছে।’
রায় সাহেবের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের মোড়ের মুদি দোকানি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাইকে ছিল তিনজন। পেছনে ছিল পাঁচজন। তারা দ্রুত দক্ষিণ দিকে চলে যায়। পরে পেছন পেছন পুলিশ যেতে দেখা যায়।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দুটি মোটরসাইকেলে ছয়জন এসে পুলিশের চোখে স্প্রে করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তারা পুলিশের গায়ে হাত তুলেছে। স্প্রে করার কারণে পুলিশ সদস্যরা চোখে দেখতে পাননি।
‘ডিবি পুলিশ প্রত্যেকটা জায়গায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করছে। আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করছি। সবাই কাজ করছে। তাদের (পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি) শিগগিরই গ্রেপ্তার করা হবে।’