বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ক্রমিক বিশৃঙ্খলায় প্রাণঘাতী সড়ক

  •    
  • ২০ নভেম্বর, ২০২২ ১১:৩৬

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বিশৃঙ্খলা থেকে। একই মহাসড়কে ভিন্ন ভিন্ন গতির গাড়ি চলাচল করে। দুই চাকার বাহনকে নিরুৎসাহিত করার বদলে উল্টো উৎসাহিত করা হচ্ছে। রাস্তায় হাটবাজার বসছে। সর্বোপরি কর্তৃপক্ষের মনোযোগ শুধু বড় বাজেটের বড় প্রকল্পের দিকে।

দিনটি ছিল এ বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি। বাবার মৃত্যু-পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন ৫ ভাই। ফেরার পথে কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপের চাপায় পিষ্ট হয়ে মারা যান তারা সবাই।

এ খবর নাড়া দেয় সারা দেশের মানুষকে। সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডিতেই শেষ হয় না। দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) প্রায় ৫ দশমিক ১ শতাংশ ক্ষতি হয়। অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা কমে যায়।

অনিরাপদ সড়ক অবকাঠামোকে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া সড়কে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বিশৃঙ্খলা থেকে। বিজ্ঞানভিত্তিক সড়ক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ছোট গাড়ির রেজিস্ট্রেশনে কম উৎসাহ দেখিয়ে বড় গাড়ির বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে তারা মনে করেন।

রাস্তা দখল করে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তার যেখানে-সেখানে আবর্জনার স্তূপ, গাড়ি পার্কিং, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অপরিপক্ব চালক, আইন না মেনে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপারসহ বিভিন্ন কারণে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।এমন বাস্তবতায় ২০ নভেম্বর জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণ করছে সারা বিশ্ব। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ওপর জোর দিয়েছে জাতিসংঘ।

ভয় জাগানিয়া পরিসংখ্যানসড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে দেশের সড়কে ৪ হাজার ৬৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ৫ হাজার ২১১ জন। ওই বছর শুধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাই হয়েছে ১ হাজার ১৮৯টি, যাতে প্রাণ হারান ৯৪৫ জন।

পরের বছর দুর্ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭৩৫টি। দুর্ঘটনায় মারা যান ৫ হাজার ৪৩১ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা হয়েছে ১ হাজার ৩৮১টি, যাতে নিহত হন ১ হাজার ৪৬৩ জন।

২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৭১টি। এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৬ হাজার ২৮৪ জন। ওই বছর সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৭৮টি, মৃত্যু বেড়ে হয় ২ হাজার ২১৪ জনের।

চলতি ২০২২ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪ হাজার ৬৫৫টি। এ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৪০ জন। এই ১০ মাসে ২ হাজার ৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৯৭ জন নিহত হয়েছেন।

এই সংগঠনের তথ্য বলছে, মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য কোনো একক বাহনে এত যাত্রী মারা যাননি এবং মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ক্রমাগত বাড়ছে।

মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুধু স্বল্প দূরত্ব না, দূরপাল্লার যাত্রায়ও মোটরসাইকেল ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এ কারণেই বাইক দুর্ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। এটা কখনোই কাম্য না। ঢাকা শহরে মোটরসাইকেল চালানো আর মহাসড়কে চালানোর মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে।’

জাপানেও একসময় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল বলে জানান এ পরিবহন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘জাপান গত ১০ বছরে সড়ক থেকে প্রায় ২৫ লাখ মোটরসাইকেল সরিয়ে ফেলেছে বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে। সংখ্যা কমানোর পর তাদের দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে।’

তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ন্ত্রণের যে পলিসি থাকার কথা, সেখানেও আমরা মনোযোগী হচ্ছি না, রাজস্ব আয়ের কথা বলে অনায়াসে অনিয়ন্ত্রিতভাবে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে যাচ্ছি। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, যত বাইক সড়কে চলে, তার বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই।’

এ বিষয়ে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দেয়ার ক্ষেত্রেও আমরা বিজ্ঞানটাকে মানি না। যে আসতেছে তাকেই দিয়ে দিচ্ছি। প্রায় ৩৭ লাখ মোটরসাইকেল হয়ে গেল। সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৫০ শতাংশ তরুণ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। এত মোটর বাইক দুর্ঘটনার পরও যদি আপনারা তাদের রেজিস্ট্রেশন দিয়েই যান, রেজিস্ট্রেশন ফি অর্ধেক করে দেন, তাহলে বুঝতে হবে এখানে পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নেই।’

তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা কমানোর কথা যাদের, তারাই দুর্ঘটনার আয়োজন করছে। যারা গাড়ি রেজিস্ট্রেশন দেয়, তাদের জানার কথা চার চাকার গাড়ির তুলনায় দুই চাকার যান ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যান্য দেশে মোটরসাইকেলটাকে কিন্তু রেজিস্ট্রেশন ফি বাড়িয়ে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং চমৎকার গণপরিবহন ব্যবস্থা করা হয়। এ রকম ছোট ছোট সমস্যাগুলোকে রেখে বিনিয়োগ করে সমাধান করা যাবে না।’

শৃঙ্খলার অভাবে সড়কে নিরাপত্তা বিঘ্নিতঅধ্যাপক ড. শামসুল হক মনে করেন, সড়কে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় বিশৃঙ্খলা থেকে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘রাস্তায় দিন দিন বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। এক সড়কে দ্রুতগতি ও ধীরগতির যানবাহন চলে। রাস্তার ওপরে হাট-বাজার বসে। অর্থাৎ ভূমি ব্যবহার সড়কের সঙ্গে যে শৃঙ্খলায় হওয়ার কথা ছিল, সেই শৃঙ্খলাটা নাই। পুরা পৃথিবী বলে, দ্রুতগতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে না। গতির পার্থক্যের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। গতির পার্থক্য দিন দিন বাড়ছে। ছোট গাড়ির সংখ্যা, স্থানীয় গাড়ির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। পথচারীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘অসংগতিপূর্ণ ব্যবহার বেড়ে যাচ্ছে রাস্তার। রাস্তার পাশে ভূমি ব্যবহার অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে। প্রত্যেকটাই বিশৃঙ্খলার কারণ। এসব বিশৃঙ্খলার কারণেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। আমাদের হাইওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে, এর কারণে আমরা সড়ক উন্নয়ন করি দ্রুতগতির জন্য, কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে গেলে আমরা স্পিড ব্রেকার বানিয়ে দুর্ঘটনাটাকে কমানোর চেষ্টা করি। আর শহর এলাকায় যানবাহন বাড়তে বাড়তে গতি এত কমে যায় যে ঠোকাঠুকি হয়।

‘আমরা বিশৃঙ্খলা রেখে যদি স্বপ্নের দ্রুতগতির উন্নয়নের দিকে যেতে চাই, তাহলে সড়কব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল করতে হবে। আমরা যে বিনিয়োগগুলো করছি, সেগুলো কিন্তু সেই উদ্দেশ্যেই। কিন্তু আমরা বিশৃঙ্খলা থেকে বের হতে পারছি না, কারণ আমরা নিয়ন্ত্রণ করি না। সারা বছর ধরে যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখা দরকার, সেটাও করি না।’

রাজধানীতে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ গণপরিবহনের প্রতিযোগিতামূলক আচরণ। পরিবহন শ্রমিকদের এমন আচরণের কারণে সড়কে অনেক প্রাণ ঝরেছে।

অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘এক রুটে ১০ কোম্পানির বাস নামিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। যারা এসি রুমে বসে এক করিডরে ১০টি কোম্পানিকে অ্যালাও করল, তারাই কিন্তু সমস্যাটাকে তৈরি করে।’

জবাবদিহির অভাবঅধ্যাপক ড. শামসুল হক মনে করেন, যারা কর্তৃপক্ষ, তাদের সারা বছর ধরে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু তারা তা করেন না। বরং তারা নিজেদের সুযোগ-সুবিধার দিকে বেশি মনোযোগী। সেভাবেই প্রজেক্ট সাজান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজ হয়ে গেছে দায়বদ্ধতাহীন। পুরা চেইনের ভেতরে সবাই সুবিধাবাদী। কোনো কিছু অর্জন করতে হলে সেখানে দরদ লাগবে। দরদি কেউ সহজে হতে চায় না। তারা ভাবে, আমি যাই করি না কেন, এটার জন্য আমাকে জবাবদিহি হতে হবে না। তাহলে আমি কেন খাটতে যাব।’

দুর্ঘটনা কমার উপায় সরকারের পরিকল্পনাতেই উল্লেখ করা আছে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দুর্ঘটনা কমাতে শ্রমভিত্তিক অল্প খরচে যা করা যাবে, সেই কাজগুলো কেউ করবে না। তারা চায় মেগা প্রজেক্ট। সরকারও তাদের সঙ্গে ঢোলের বাড়ি দেয়। মেগা প্রজেক্টে গেলে তাদের লাভ, সরকারের লাভ। কিন্তু জনগণের কোনো লাভ হয় না। কারণ এগুলো সমন্বিত হয় না। ছোট কাজগুলো না করে অর্থাৎ ফাউন্ডেশনের কাজ না করে আমি আকাশে চলে গেলে তো এটা বেশি দিন থাকবে না।’

‘সড়কের উন্নয়নগুলো লোকদেখানো। এ কারণে আমরা টেকসই উন্নয়ন পাচ্ছি না। ফলে সড়ক দ্রুতগতির হলে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়।’

দুর্ঘটনা কমাতে করণীয়

অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘যদি দুর্ঘটনা কমাতে চাই, তাহলে রাস্তার পরিবেশটাকে সুশৃঙ্খল করতে হবে। নিবিড় ধারাবাহিক নজরদারির পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনের সময়ও ছোট গাড়িকে অনুৎসাহী করা এবং বড় গাড়িকে উৎসাহিত করা। তাহলে ছোট গাড়ির সংখ্যা কমে গেলে সাংঘর্ষিক পরিবেশটাও কমে যাবে।

‘পাশাপাশি রাস্তা স্বতন্ত্র থাকবে। রাস্তা সুশৃঙ্খল হলে বিশৃঙ্খলা কমে যাবে, বিশৃঙ্খলা কমে গেলে নিরাপদে দ্রুতগতিতে চলা যাবে। এ ছাড়া সব পরিকল্পনা বিজ্ঞানভিত্তিক করতে হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর