বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

খেজুরের চারা বেচে কোটিপতি

  •    
  • ১৭ নভেম্বর, ২০২২ ১২:৫৩

কয়েক বছরে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় খেজুর বাগান। একজনের সাফল্য দেখে আরেকজন খেজুর চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। গত প্রায় দুই যুগে চারা বিক্রি করে বিপুল আয় করেছেন আব্দুল মোতালেব। পরিচিতরা তাকে ‘কোটিপতি খেজুর মোতালেব’ বলে অভিহিত করছে। তার বাগানে উৎপাদিত চারা যাচ্ছে সারা দেশে।

দেশে ভোজনরসিকদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় সৌদি আরবের খেজুর। একসময় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, পাকিস্তান ও ভারত থেকেও খেজুর আমদানি হতো। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে সৌদি খেজুরের চাষ গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। উৎপাদন হচ্ছে বিপুল পরিমাণ খেজুর।

খেজুরসহ চারা বিক্রির মাধ্যমে চাষিরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি শৌখিন ব্যক্তিরাও খেজুর চাষে ঝুঁকছেন।

কয়েক বছরে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় খেজুরবাগান। একজনের সাফল্য দেখে আরেকজন খেজুর চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। গত প্রায় দুই যুগে চারা বিক্রি করে বিপুল আয় করেছেন আব্দুল মোতালেব। পরিচিতরা তাকে ‘কোটিপতি খেজুর মোতালেব’ বলে অভিহিত করছে। তার বাগানে উৎপাদিত চারা যাচ্ছে সারা দেশে।

আব্দুল মোতালেবের বাড়ি ভালুকা উপজেলার পাড়াগাঁও গ্রামে। ১৯৯৮ সালে সৌদি আরব গিয়ে একটি খেজুর বাগান দেখাশোনার কাজ করেন তিনি। নিয়মিত কাজ করে চারা উৎপাদনসহ খেজুর উৎপাদনে পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর দেশে খেজুর চাষের পরিকল্পনা করেন। তিন বছর পর ৩৫ কেজি বিভিন্ন জাতের খেজুর নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। ২০০১ সালে নিজের বাড়ির পাশে শুরু করেন খেজুরের বাগান তৈরির কাজ।

গত বছর প্রায় ১২০টি গাছ থেকে ৬ লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করেছেন তিনি। ছোট আকৃতির প্রতিটি চারা ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং ফলধারক একটি গাছ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন।

আব্দুল মোতালেবের বাগানে এখন ২ হাজার ছোট-বড় গাছ রয়েছে। প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ২৫০ কেজি খেজুর ধরে। আজোয়া জাতের খেজুর প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা, আমবাগ প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা, সুকারি ১৫০০ টাকা ও বরকি ১৫০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়।

আব্দুল মোতালেব একসময় পরিবার নিয়ে মাটির ঘরে বসবাস করতেন। খেজুর বাগান থেকে আয়ের টাকায় তিনি দ্বিতল ভবনের বাড়ি করেছেন, ছয় বিঘা জমি কিনেছেন, যার মূল্য কোটি টাকার ওপরে।

মরুভূমির উত্তপ্ত আবহাওয়ায় উৎপাদিত ফল এ দেশে চাষ করার ক্ষেত্রে মোতালেবের ব্যাপক সাফল্য দেখে এ অঞ্চলের অনেক বেকার যুবক এখন সৌদি খেজুরের চাষ করছেন।

তাদের একজন আফাজ পাঠান। তিনি পাশের পাড়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৬ সালের শেষের দিকে দুই বিঘা জমিতে বীজ বপন করেন তিনি। সে বছরই আড়াই হাজার চারা হয়। বর্তমানে ১০ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন খেজুর বাগান। সৌদি আরবের ১০ জাতের খেজুরের প্রায় ৫ হাজার গাছ ও ৫ হাজার চারা আছে তার বাগানে। প্রতিটি চারা ২ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।

আরেকটি খেজুর বাগানের মালিক আজিজুল হক। মোতালেবের বাগান দেখে তিনিও দুই একর জায়গায় বাগান শুরু করেন। খেজুরের চেয়ে চারা বিক্রি করেই লাভবান তিনি। স্থানীয় লোকজনসহ দূর-দূরান্তের লোকজন বাড়ির আঙিনায় কিংবা বিভিন্ন রিসোর্টের শোভাবর্ধনের জন্য কিনে নিচ্ছেন খেজুরের চারা।

তবে অনেকের প্রশ্ন : আসলেই কি কিনে নেয়া ওইসব গাছ থেকে সব মাটিতেই ফল ধরছে? নাকি হুজুগে চারা কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা?

এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ উপজেলায় উৎপাদিত চারা সারা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বিক্রি করা হচ্ছে। বিভিন্ন রিসোর্টের শোভাবর্ধনসহ গাছের টাটকা ফল খেতে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছেন চারা। বেশির ভাগ ক্রেতার গাছে ধরছে ফল। তবে ফল ধরানো নিশ্চিত করতে বাগানিদের সঙ্গে আলাদা চুক্তি করতে হয়। ভালো টাকা পেলে নিজ হাতে চারা লাগানোসহ সবধরনের পরিচর্যা করে ওই গাছে খেজুর ফলিয়ে দেন তারা।

উপজেলার মাস্টারবাড়ি এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম খেজুর চাষি মোতালেবের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন দশটি চারা। ফল ধরেছে কিনা জানতে কথা হয় তার সাথে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোতালেব সৌদির খেজুর চাষে আলোড়ন তুলেছেন জানতে পেরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। গত ৭ বছর আগে দশটি চারা সংগ্রহ করি। এর মধ্যে তিনটি গাছে খেজুর ধরেছে। স্বাদও সৌদি আরবের খেজুরের মতোই।’

জহির উদ্দিন নামে আরেক বাগানি বলেন, ‘আমি আফাজ পাঠানের কাছ থেকে তিনটি চারা কিনেছিলাম। এর মধ্যে একটি গাছে খেজুর ধরছে। পরে চাষিকে জানালে তিনি আরও একটি চারা কিনতে বলেন। সে অনুযায়ী বেশি দামে আরেকটি চারা কিনে লাগালে চাষি মাঝেমধ্যে এসে নিজেই পরিচর্যা করার পাশাপাশি কৌশল শিখিয়ে দেন। গত বছর ওই গাছেও খেজুর ধরেছে।’

জানতে চাইলে মোতালেব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেশে ফিরে আমার বাড়ির পাশে একটি জমিতে খেজুরের চারা রোপণ করি। কিন্তু প্রায় সব গাছই পুরুষ হয়ে যাওয়ায় খেজুর হয়নি। আবার গাছ লাগালে আবারও একই অবস্থা। তৃতীয় দফায় দুটি গাছে খেজুর হয়। সেই দুই গাছ থেকে বর্তমানে ২ হাজার চারা উৎপাদন করেছি। প্রতি বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মুকুল আসে এবং জুন-জুলাইয়ে ফল পাকবে।

‘গত বছর ২০০ গাছের খেজুর ৬ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। ওই বছর চারা বিক্রি করে ২৫ লাখ টাকা লাভ হয়েছে। চলতি বছর আরও বেশি টাকার চারা বিক্রি সম্ভাবনা আছে।’

মোতালেব বলেন, ‘ভালুকার মাস্টারবাড়ি, ঢাকার উত্তরা, বনানী, চট্টগ্রাম ও মানিকগঞ্জে প্রচুর চারা বিক্রি হয়েছে। অনেকে বাগান করার জন্য শতাধিক চারা একসঙ্গে কিনতে আসেন। লিখিত চুক্তিপত্রের মাধ্যমে তাদের কাছে চারা বিক্রি করা হয়। তারা বেশি দামে চারা কেনেন। আমিও নিজ হাতে চারা রোপণ করে দিয়ে আসি। যাদের চারা দিয়েছি, সবাই জানিয়েছে খেজুর ধরেছে। তবে কিছু পুরুষ চারা হওয়ায় ও পরিচর্যা যথাযথভাবে না পাওয়ায় ফল আসেনি।’

আফাজ পাঠান বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ধারণা ছিল, খেজুর সব মাটিতে হয় না। এটি আমি ভুল প্রমাণিত করেছি। ঢাকার বনানী, আব্দুল্লাহপুর, কেরানীগঞ্জ, সিলেট , নীলফামারীর সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বিপুল পরিমাণ চারা বিক্রি করেছি। সব জায়গায় লাগানো গাছে ফল এসেছে। স্বাদে, গন্ধে ও রসে টইটম্বুর খেজুর।’

তিনি বলেন, ‘সৈয়দপুরে এরা গার্মেন্সের মালিক সালাউদ্দিন ১০০টি গাছের চারা নিয়েছেন। এর মধ্যে সাত গাছে খেজুর ধরেছে। বাকিগুলোতেও ধীরে ধীরে ফলন আসবে। যারা চারা কেনেন, তাদের মোবাইল নম্বরে পরিচর্যার বিষয়ে বিভিন্ন সময় পরামর্শ দেওয়া হয়।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ময়মনসিংহের উপপরিচালক মো. মতিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পৃথিবীতে প্রায় ১ হাজারের বেশি খেজুরের জাত রয়েছে, এর মধ্যে সৌদি আরবে ৪০০ এর বেশি জাতের খেজুর উৎপাদন হয়। বাংলাদেশে জনপ্রিয় জাতের মধ্যে আজওয়া, বেরহি, সামরান, জাহেদি, মরিয়ম, আনবারাহ, আসমাউল হাসনা, ইয়াবনি অন্যতম। এর মধ্যে আজওয়া, বেরহি এবং মরিয়ম জাতের খেজুর বেশি চাষ হচ্ছে।’

তিনি জানান, বীজ থেকে তৈরি গাছে প্রকৃত জাতের গুণাগুণ থাকে না বা কম থাকে। এ কারণে বীজের চেয়ে চারার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। খেজুর চাষের ক্ষেত্রে পুরুষ ও স্ত্রী গাছের চারা নির্বাচনে চাষীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ অধিকাংশ চারা পুরুষ হয়ে যায়। এ জন্য সতর্কতার সঙ্গে চারা নির্বাচন করতে হয়। ভালুকার লাল মাটিতে খেজুরের উৎপাদন বাড়ছে। খেজুর চাষে কেউ আগ্রহী হলে সব ধরনের পরামর্শ দেয়া হবে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল কাদের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের আবহাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক উষ্ণ হয়ে উঠেছে। গ্রীষ্মের ভাব বেশি সময় ধরে থাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মাটিতে এখন আগের চেয়ে লবণাক্ততার পরিমাণও অনেক বেড়েছে। কারণে এ দেশে সৌদি আরবের খেজুর উৎপাদন হচ্ছে।’

খেজুরের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে তিনি জানান, খেজুরে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল আছে। রক্তশূন্যতা ও ডায়রিয়া নিরাময়ে এবং সুস্থ গর্ভধারণে এ ফল উপকারী। এ ছাড়া হজমশক্তি বাড়ানো, রক্তস্বল্পতা দূর করাসহ কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতেও কাজ করে খেজুর।

এ বিভাগের আরো খবর