গ্রাম পেরিয়ে ফসলি জমির আল ধরে কিছুটা পথ এগোলেই চোখে পড়ে নেট ঘেরা ছোট একটি বাগান। বাগানের সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে ছোট ছোট পাকা কমলা। সূর্যের আলোয় সেই পাকা কমলা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
বগুড়া সদরের গোকুল ইউনিয়নের পলাশবাড়ী গ্রামে গেলে এই ছোট্ট বাগানটি চোখে পড়বে। চার বছর আগে এই গ্রামের বাসিন্দা আজিজার রহমান ৬ শতক জমিতে কমলার বাগান গড়ে তোলেন। এই উদ্যোগে সহায়তা করেন তার ছেলে মাহমুদ ইসলাম বাবুল। এরই মধ্যে বাগানের কমলা স্থানীয়ভাবে বিক্রি করে সাড়া ফেলেছেন বাবা-ছেলে।
এই কৃষকের দাবি, চার বছর বয়সী প্রতিটি গাছ থেকে অন্তত ১০ হাজার টাকার কমলা বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি গাছের ডাল থেকে তৈরি কলমের চারা বিক্রি করেও লাখ টাকা আয় করেছেন তারা।
ছোট বাগানটি ঘুরে দেখা যায়, ছয়টি গাছে কমলা ধরে আছে। এর মধ্যে তিনটি গাছে পাকা কমলা বেশি। অন্যগুলো একেবারেই শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি রয়েছে মাল্টার গাছ। আর ডজন খানেক কমলার চারা গাছ।
কমলা চাষের শুরুর গল্প নিয়ে কথা হয় আজিজার রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাজারে বিদেশি ফল না কিনে নিজে চাষ করে খাওয়ার শখ ছিল আগে থেকেই। আর প্রচলিত ধান, আলুর চেয়ে ফলদ গাছ চাষে লাভ বেশি। তাই ২০১৮ সালের নভেম্বরে আমার ছেলে বাবুল কুষ্টিয়া থেকে ১৭টি চায়না থ্রি জাতের কমলার চারা নিয়ে আসে। প্রতি চারার দাম ছিল ৩০০ টাকা।’
আজিজার রহমানের বাগানে ওই চারাগুলোতে পরের বছর কমলার ফুল আসে। কিন্তু প্রথম বছর ফুল ফেলে দেয়া হয়। গত বছর থেকে কমলা বিক্রি করা শুরু করেন এই শৌখিন ফলচাষি। তবে প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বেশি বিক্রি হয়েছে।
আজিজার বলেন, ‘এলাকায় প্রথম কমলার বাগান। অনেকে চিনতই না। খেয়েই পরিচিতি হয়েছে এই কমলার। প্রতি কেজি ১০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। গাছে কমলা ধরার পর থেকেই সবাই বাগানে আসে। প্রতিবেশীরাই বেশি কমলা কিনেছেন। আবার এমনিতেও দেয়া হয়েছে। ছোট বাচ্চারা এসে গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে যায়।’
তিনি আরও জানান, এ বছর মহাস্থান হাটে প্রায় ৪০ কেজি কমলা বিক্রি করা হয়েছে। এখনও কয়েকজন ব্যবসায়ী নিচ্ছেন।
চায়না থ্রি কমলার ফলন আসতে অনেক সময় নেয় বলে জানান এই কৃষক। সাধারণত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে গাছে ফুল আসে। সেখান থেকে কমলা বড় হয়ে নভেম্বরের দিকে পাকা শুরু করে। প্রতি গাছে অন্তত ২০০ কেজি কমলা পেয়েছেন আজিজার রহমান।
চারা রোপণের এক বছর পর থেকে কমলার ফুল ধরেছিল। কিন্তু তিনি সেই ফুল রাখেননি। গাছের মান ভালো রাখতে ফুল ফেলে দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘আমি এই গাছগুলো থেকে এখন পর্যন্ত ৮ হাজার চারা করেছি। আলাদা দুটো বাগানে চারাগুলো করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ১৪ শতকের বাগান। অপরটি ২৮ শতক।’
পাকা কমলা কম বিক্রি করলেও নিয়মিত কলমের চারা বিক্রি করছেন আজিজার রহমান। প্রতিটি চারা ১৬০ টাকা থেকে ২০০ টাকা।
আজিজার রহমান বলেন, ‘ছয় শতকের বাগানে ৩ হাজার পিস চারা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২ হাজার চারাই বিক্রি করেছে আমার ছেলে। এতে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা লাভ হয়।’
কমলা চাষের খরচ সম্পর্কে আজিজার রহমান বলেন, ‘চার বছর আগে শুরুর সময় জৈব ও রাসায়নিক সার দেয়া হয়েছিল। এরপর তেমন খরচ হয়নি, কারণ বেশির ভাগ কাজ আমরা নিজেরাই করি। গড় হিসাবে প্রতিবছর সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ব্যয় হয়।’
এ ব্যবধানে আয় অনেক বেশি বললেন আজিজার। তিনি বলেন, কমলা ঠিকমতো ধরলে প্রতি গাছে প্রায় ১২ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এ জন্য নতুন করে বাগান করা হচ্ছে।
পলাশবাড়ী গ্রামের আরেক বাসিন্দা ও মুদি দোকানদার আনিছার রহমান বলেন, ‘আজিজার রহমান সম্পর্কে আমার চাচা হন। তার কমলার বাগান শুরু থেকে আমরা জানি। চাচার বাগানের কমলা খেয়েছি। কেনাও হয়েছে। এটা অনেক ভালো জাতের।’
বগুড়া সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ইসমত জাহান বলেন, ‘বগুড়া সদরে প্রায় ১০ হেক্টর জমিতে কমলা ও মাল্টার চাষ করা হচ্ছে। প্রচলিত ধান, আলু, সরিষার চেয়ে এই ফল চাষ অনেকটাই লাভজনক। আর বগুড়া অ্যাগ্রো-ইকোলজিক্যাল এরিয়া। এখানকার মাটিও কমলা চাষের উপযোগী। গোকুলের আজিজার রহমান নামে এক কৃষক কমলার চাষ করেছেন। ফলের পাশাপাশি তিনি চারাও বিক্রি করছেন। এতে দুইভাবেই লাভবান হচ্ছেন। এটা আমাদের উপজেলার জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।’