বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিয়ে যে উদ্বেগ তাতে বাংলাদেশের উৎকণ্ঠা কমাতে পারে বেশ কিছু উদ্যোগ। গবেষকরা উচ্চ ফলনশীল ও উচ্চ পুষ্টিকর জাতের চাষের পাশাপাশি সাথি ফসল চাষের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে শিল্প সমাদৃত হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে কৃষির গুরুত্ব কতটা বেশি। বিশ্বে খাদ্য সরবরাহের কেন্দ্রে এই লড়াইয়ের কারণে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলাবলি হচ্ছে। খাদ্য আমদানি করতে না পারলে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক।
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। কোনো জমি যেন অনাবাদী না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে চাইছেন তিনি।
এই বাস্তবতায় মঙ্গলবার দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় কৃষি দিবস। ২০০৮ সাল থেকে ১৫ নভেম্বর দিবসটি উদযাপন করা হচ্ছে। অন্যান্য বছর এই দিনটি জনমানসে সেভাবে গুরুত্ব না পেলেও বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এবার গুরুত্ব পাচ্ছে অনেক।
জন্মের পাঁচ দশকে বাংলাদেশ কৃষিতে যা করেছে, তা ভাবাও যায়নি। জন্মের আগে সাত কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারলেও এখন ধান, সবজি, মাছসহ নানা কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানেই থাকে বাংলাদেশ।
কৃষিতে এই বিপ্লবে গবেষকদের ভূমিকা গত কয়েক বছর ধরেই সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। গবেষণায় অন্যান্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা বিশ্বমানের- এই বিষয়টি যারা প্রতিষ্ঠিত করছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
তাদের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের ধান, সবজি, ফল, পশু-প্রাণীর জাত উৎপাদন বাড়াতে রাখছে ভূমিকা। বিরূপ প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতেও এই জাতগুলো উৎপাদন দিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এখনও ধান, গমসহ নানা ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, কৃষিতে অর্জন অনেক। তবে থেমে থাকার সুযোগ নেই। যেখানে যেখানে উন্নতির সুযোগ আছে, সবটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে।
ক্যাম্পাসে দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিউট (বিনা) এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিউটের (বিএফআরআই) প্রধান কার্যালয় রয়েছে। রয়েছে দেশের একমাত্র জার্মপ্লাজম সেন্টার যেটি ফলদ বৃক্ষের একটি অনন্য সংগ্রহশালা।
বিজ্ঞানীরা কেবল জাত উদ্ভাবন করেই ক্ষ্যান্ত হচ্ছেন না, কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ মাঠপর্যায়ের নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন৷
ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রাশিদুর রহমান সাথি ফসল চাষে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অনেক কৃষক না বুঝে আখ বা ভুট্টা চাষের সময় সাথি ফসল হিসেবে অন্য কিছু চাষ করেন না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা ইচ্ছে করলেই এক লাইন থেকে আরেক লাইনের মাঝখানে থাকা ফাঁকা জায়গায় বিভিন্ন সবজি ও ডালজাতীয় ফসল চাষ করে লাভবান হতে পারেন।’
তার মতে উচ্চ ফলনশীল ও অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত চাষাবাদে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার বিকল্প নেই।
অধ্যাপক রাশিদুর রহমান জানান, তারা দেশে কালো ধানের উৎপাদন ছড়িয়ে দিতে কাজ করছেন। বলেন, ‘বান্দরবান, রাঙ্গামাটি জেলার উঁচু জমিতে কিংবা বিভিন্ন পাহাড়ে ধান থেকে পাওয়া যায় এই চাল। সবাই জানে পাহাড় ছাড়া কালো চাল উৎপাদন করা সম্ভব না। কিন্তু আমি ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে কালো ধানের একটি জাত এনে গবেষণা করেছি। এতে দেখা যায়, ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ রাজশাহীর সমতল জমিতে ধান থেকে ভালো চাল হয়েছে।’
তিনি জানান, কালো চালের ভাত সাদা ভাতের চেয়ে চার গুণ বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ, স্বাস্থ্যকর এবং এই চালের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অনেক বেশি। বিশেষ করে ক্যানসার রোধ করতে পারে এটি। এ চালে শর্করার পরিমাণ সাদা চালের চেয়ে কম, অন্যদিকে আঁশ ও ভিটামিন বি-এর পরিমাণ বেশি।
একই বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পারভেজ আনোয়ার বলেন, ‘ছোট্ট এ দেশে মানুষের সংখ্যা বেশি। এ জন্য উন্নত জাত চাষাবাদের বিকল্প নেই। নতুন নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টি হওয়ায় কৃষকরা বেশি ফসল ফলাতে পারছেন৷ সব কৃষকদেরকেই প্রযুক্তির আওতায় আসতে হবে। বিশেষ করে পতিত জমি ফেলে রাখা যাবে না।’
বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামসুল আলম মিঠু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুর্ভিক্ষের সময় সবকিছুতেই সংকট দেখা হয়। যে যা সামনে পাবেন, তা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করেন। শাকসবজি, মসলাসহ সবকিছুর দামই বাড়তে থাকে। ফলে অল্প জায়গায় বেশি গাছ লাগিয়ে বেশি ফলনের দিকে নজর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ফল এদেশে আমদানি করতে হয়। ফলে আমদানি বন্ধ করে রপ্তানি করতে আমাদের জোরেশোরে গবেষণা চলছে। বর্তমানে আমাদের কাছে ৪৮ প্রজাতির ১ হাজার ৩০০ ফলের মাতৃগাছ রয়েছে। এগুলো অল্প সময়ে অধিক ফলন দেয়। এসব চারা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে প্রচেষ্টা চলছে। এ ছাড়া আমরা উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন মসলা ও লেবুজাতীয় ফসলের চারা বিতরণ করছি।’
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, তারা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশীয় মাছের উৎপাদন বাগানোর চেষ্টা করছেন।
দেশে স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় মাছের সংখ্যা ৬৪টি। ইতোমধ্যে ৩২টি দেশীয় মাছের পোনা কৃত্রিম প্রজননে উৎপাদন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব মাছের পোনা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে প্রচেষ্টা চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লুৎফল হাসান বলেন, ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকে নিরলসভাবে উচ্চ মানের কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কৃষিযন্ত্র উদ্ভাবনে কাজ শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ এবং বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।’