চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে বোনের বিয়ের কথা গোপন রাখায় নিজের মেয়েকে চাবুক মেরে খুনের ১৩ বছর পর কথিত পির আব্দুল মতিনসহ ৫ আসামির বিচার শুরু হয়েছে।
সোমবার দুপুরে অতিরিক্ত দ্বিতীয় মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আমিরুল ইসলামের আদালত এই বিচার শুরুর নির্দেশ দেয়।
বিষয়টি নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেছেন মামলার আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান।
আদালত সূত্রে জানা যায়, নিজের মেয়েদের চিরকুমারী রেখে রাবেয়া বসরীর মত তাপসী বানানোর পরিকল্পনা ছিল কথিত পির আব্দুল মতিনের। কিন্তু এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে তার এক কন্যা ফুফাত ভাইকে গোপনে বিয়ে করে। আর এই বিয়ের কথা গোপন রাখায় পাহাড়তলীর গ্রিনভিউ আবাসিকের একটি বাড়িতে অন্য তিন মেয়েকে চাবুক মারার নির্দেশ দেন আব্দুল মতিন।
পির মতিনের নির্দেশে সৎমা ডা. শাহিদা বেগম, চাচা আব্দুস সবুর, মতিনের প্রেমিকা নার্গিস ও ছোটবোন বিনু বেগম হাফসাকে চাবুক মেরে হত্যা করেন। এ সময় হাফসার অন্য দুই বোনও চাবুকের আঘাতে মৃতপ্রায় অবস্থা হয়।
হাফসার মৃত্যুর পর গোপনে ঘরের ভেতর তড়িঘড়ি করে জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করে হত্যাকারীরা।
এই ঘটনায় পরে নিহতের ভাই স্থানীয় থানায় মামলা করতে গেলে মামলা নেয়নি পুলিশ। বিষয়টি জানতে পেরে এবং প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়ে নিহতের স্বজনদের (ভাই-বোন) আইনি সহায়তা দেয় বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন।
সংগঠনটির সহায়তায় ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর নিহতের ভাই আবু দারদা নিজের বাবা পির মতিনসহ মতিনের স্ত্রী ডা. শাহিদা বেগম, ভাই আব্দুস সবুর, প্রেমিকা নার্গিস, ছোটবোন বিনু, বাড়িওয়ালা শফিকুল ইসলাম, তার স্ত্রী উলফাতুন নেছা এবং হাফসার মা রওশন আরা বেগমকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন।
আদালত মামলাটি গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট থানাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। এ ছাড়া ওই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নিহত হাফসার মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে আদালতের নির্দেশে ময়নাতদন্তও করা হয়।
মামলার তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। প্রতিবেদনে হত্যার ঘটনাটিকে ‘ভুল বুঝাবুঝি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এ প্রতিবেদনের বিষয়ে মামলার বাদী নারাজি দিলে আদালত মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন সহকারী কমিশনারকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্ত শেষে পির মতিন, মতিনের ভাই সবুর, স্ত্রী শাহিদা, প্রেমিকা নার্গিস ও ছোটবোন বিনুকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, কথিত পির আব্দুল মতিনের চার স্ত্রীর সংসারে ২৪ সন্তান। তা ছাড়া নার্গিস নামে এক নারীর সঙ্গে বিয়ে বহির্ভূতভাবে ঘটনার চার বছর আগে থেকে বসবাস করতেন।
নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্ন তুললে অন্য স্ত্রীদের দোজখের ভয় দেখাতেন মতিন।
তার স্ত্রীদের মধ্যে দুজন উচ্চ শিক্ষিত (এমবিবিএস ডাক্তার) হলেও সন্তানদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেন। এর মধ্যে কন্যাদের চিরকুমারী থেকে তাপসী রাবেয়া বসরীর মতো হয়ে নিজের মতবাদ প্রচারের মনগড়া ফতোয়া দেন তিনি।
বাবার ফতোয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে হাফসার বড় বোন উম্মে হাবিবা ফুফাত ভাই রোজিন রহমানকে বিয়ে করে তার কাছে চলে যান। বিয়ের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন হাবিবার ছোট তিন বোন ১৫ বছর বয়সী উম্মে রুম্মান, ১৯ বছর বয়সী উম্মে আয়েশা ও ২৩ বছর বয়সী হাফসা।
পরে বিয়ের বিষয়টি জানাজানি হলে ক্ষিপ্ত হয়ে গোপন রাখার অপরাধে তিন কন্যাকে চাবুক মেরে শাস্তির নির্দেশ দেন পির মতিন। নির্দেশ দিয়ে হাফসার মা রওশান আরা সহ এক শিষ্যের বাড়িতে চলে যান তিনি।
এদিকে পিরের নির্দেশে ২০০৯ সালের ১৮ আগস্ট রুম্মান, আয়েশা ও হাফসাকে মাথা ন্যাড়া করে বেত্রাঘাত করেন অভিযুক্তরা।
১৮ আগস্ট সকাল ৮টা থেকে সারাদিন থেমে থেমে তিনবোনকে বেত্রাঘাত করা হয়। তাদের মধ্যে রুম্মান ও আয়েশার অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়লে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। পরদিন শুধু হাফসার ওপর চলে নির্যাতন।
হাফসার হাত-পা ও কোমড় শিকল দিয়ে বেঁধে বেত্রাঘাত করে নির্যাতন চালান অভিযুক্তরা। বেত্রাঘাতের পর গুরুতর আহত হাফসাকে একটি কক্ষে অনাহারে আটকে রাখা হয়।
এ সময় হাফসার অনবরত রক্তবমি শুরু হলে তিনি বাঁচার জন্য আবদ্ধ কক্ষে চিৎকার শুরু করেন। কিন্তু কেউ এসে উদ্ধার না করায় রাতের কোনো এক সময় মারা যান তিনি।
এরপর ডাইরিয়ায় হাফসার মৃত্যু হয়েছে প্রচার করে গোপনে তাকে দাফন করেন অভিযুক্তরা। শুধু তাই নয়, হাফসার মৃত্যুর পর তার মা রওশন আরাকে ‘শহীদের মা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
এই মামলায় ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আসামিদের বিচার শুরুর নির্দেশ দেয় আদালত। তবে একইদিন আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতে মামলা বাতিলের আবেদন (কোয়াশম্যান্ট) করলে রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উচ্চ আদালত বিচারিক আদালতের মামলায় স্থাগিতাদেশ দেয়। পরে ২০১৯ সালের ১৪ মে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে ৬ মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত।
আসামিপক্ষের আবেদন খারিজের পর বিচারিক আদালতে আবারও কার্যক্রম শুরু হয়েছে মামলাটির।