পরিবহন ধর্মঘটের ‘বাধা’ পেরিয়ে পাঁচ বিভাগে বড় ধরনের সমাবেশ শেষে বিএনপির লক্ষ্য এবার সিলেট। আগামী শনিবার দেশের উত্তর-পূর্বের প্রধান এই শহরটিতেও ব্যাপক জমায়েতের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।
প্রতিদিনই বিভাগের নানা জনপদে মিছিল, লিফলেট বিতরণ চলছে। প্রচার চলছে সামাজিক মাধ্যমেও। দলটির কেন্দ্রীয় নেতারাও সিলেটে অবস্থান করে সমাবেশের প্রস্তুতি সমন্বয় করছেন।
এক সপ্তাহ আগে থেকেই সমাবেশস্থল সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মঠে মঞ্চ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। মাঠের আশপাশের এলাকা ছেয়ে গেছে নেতাদের ছবিসহ ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ডে।
এর আগে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালে হয়েছে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ। মধ্যাঞ্চলে ফরিদপুরেও হয়েছে জমায়েত। বন্দরনগরী ছাড়া প্রতিটি সমাবেশই হয়েছে পরিবহন ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে। তবে তাতে জমায়েতে কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। প্রতিটি সমাবেশই হয়েছে বিশাল। সিলেটের সমাবেশে ৪ লক্ষাধিক লোকের জমায়েতের চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন নেতারা।
এখন পর্যন্ত সিলেটে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত না এলেও নেতা-কর্মীরা আশঙ্কা করছেন এবারও কোনো না কোনো অজুহাতে ধর্মঘট ডাকা হবে। সে জন্য প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন নেতা-কর্মীরা।
সমাবেশের জন্য ছয় কমিটি
বিএনপির এই ছয় কমিটির মধ্যে ‘আবাসন ব্যবস্থাপনা’ কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা কমিটি’র আহ্বায়ক হিসেবে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির।
'প্রচার ও মিডিয়া কমিটি’র আহ্বায়ক জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, ‘অভ্যর্থনা কমিটি’র আহ্বায়ক মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকী, ‘আপ্যায়ন কমিটি’র আহ্বায়ক মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নাসিম হোসাইন এবং ‘দপ্তর কমিটি’র আহ্বায়ক করা হয়েছে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ূন কবির শাহীনকে।
এসব কমিটিতে সিলেট বিভাগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিএনপির জেলা, মহানগর, পৌরসভা, উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাদেরও সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মঈন খান এবং যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বিএনপির নিখোঁজ নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা, এনামুল হক চৌধুরী ও খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান জীবন ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন আহমদ মিলনও সার্বক্ষণিক তদারকিতে আছেন।
জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘গত শনিবার থেকে প্রতিটি কমিটি নিজেদের কাজ শুরু করেছে। কমিটির বাইরেও দলের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মী স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবেশ সফলে কাজ করছেন।’
৪ লাখ লোকসমাগমের আশা
জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটের সমাবেশে অন্তত ৪ লাখ মানুষের সমাগম হবে। যেভাবে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে জমায়েত আারও বেশিও হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘কেবল সমাবেশ মাঠ নয়, ১৯ নভেম্বর পুরো সিলেট হবে মিছিলের নগর। মাঠের আশপাশের এলাকায় মানুষের ঢল নামবে।’
পরিবহন ধর্মঘট মাথায় রেখেই এই জমায়েতের আশা করা হচ্ছে জানিয়ে কাইয়ুম বলেন, ‘ধর্মঘট ডাকলেও কাজ হবে না। বিকল্প উপায়ে আমাদের নেতা-কর্মীরা সমাবেশে আসবেন। সে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
বিএনপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, দুই-তিন দিন আগেই অনেকে সিলেটে চলে আসবেন। তাদের জন্য থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সমাবেশ সফলে প্রতিদিনই সিলেট নগরের পাশাপাশি বিভাগের প্রত্যন্ত এলাকায়ও প্রচার চালাচ্ছেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা। আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারাও নিজেদের উদ্যোগে সমবেশে বড় শোডাউন দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
শনিবার বিকেলে নগরের কানিশাইল এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আবদুল মুক্তাদির। তিনি বলেন, ‘১৯ নভেম্বর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের গণসমাবেশ ইতিহাস সৃষ্টি করবে। গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে শুধু জাতীয়তাবাদী শক্তি নয়, গণতন্ত্রকামী সিলেটবাসীর মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সূচনা হয়েছে। সিলেটবাসী সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে গণসমাবেশ সফলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।’
বাধা নেই, তবে শঙ্কা আছে
সিলেটে এই সমাবেশ নিয়ে শুরুতেই দেখা দেয় বিপত্তি। নগরের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জমায়েতের কথা ছিল গত ২০ নভেম্বর। কিন্তু আলিয়া মাদ্রাসায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় ৬ নভেম্বর থেকে। আর তার দুই দিন আগে পরীক্ষাকেন্দ্রের আশপাশের ২০০ গজ এলাকায় জমায়েত নিষিদ্ধ করে সিলেট মহানগর পুলিশ।
ফলে বাধ্য হয়ে সমাবেশ এক দিন এগিয়ে আনে বিএনপি। ১৯ নভেম্বর এইচএসসি পরীক্ষা নেই বলে সেদিনই হবে জমায়েত।
তবে ৬ নভেম্বর সমাবেশ এগিয়ে আনার ঘোষণা দেয়ার রাতে ঘটে বিপত্তি। নগরের বড়বাজার এলাকার দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক আ ফ ম কামাল। প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল থেকে নগরের রিকাবীজারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ভাঙচুর করেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারা। তারা পাল্টা মিছিল করে ছবি ভাঙচুরকারীদের গ্রেপ্তার করা না হলে বিএনপির সমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
এরপর ৮ নভেম্বর বিএনপির অজ্ঞাত ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য জাহিদ সারোয়ার সবুজ।
দুই দলের এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে সমাবেশ নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। তবে এখন পর্যন্ত প্রচারে কোনো বাধা আসেনি বলে জানিয়েছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সমাবেশের প্রচার জোরেশোরেই চলছে। এখন পর্যন্ত প্রশাসন বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে আমাদের বাধা দেয়া হয়নি। তবে ২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’
তিনি বলেন, ‘মামলার আসামিদের নাম উল্লেখ থাকলে আমরা জামিন নিতে পারতাম। কিন্তু কোনো আসামির নাম উল্লেখ করা হয়নি। এতে সমাবেশের আগে নেতা-কর্মীদের পুলিশ হয়রানি করতে পারে বলে আমরা মনে করছি।’
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেবে না পুলিশ
মহানগর পুলিশের কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, ‘বিএনপি যদি কোনো বিশ্খৃলা সৃষ্টি না করে, মানুষের জানমালের ক্ষতি এবং জনগণের চলাচলে বিঘ্ন না ঘটিয়ে তাদের কর্মসূচি পালন করে, তবে পুলিশ তাতে কোনো বাধা দেবে না। তবে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হলে তা প্রতিহত করা হবে।’
বিএনপির ২৫০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর করা হয়েছে এটা তো সত্য। তাই এ ঘটনায় মামলা হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবে মামলায় নিরীহ কাউকে যাতে হয়রানি করা না হয় এ ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।’