রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম-এর কথা বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা উল্লেখ করে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধান ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ৪ নভেম্বর সংবিধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ বক্তারা এমন দাবি জানান।
সভায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘একাত্তরের গণহত্যা ধর্মের নামেই হয়েছে। আর এসব হয়েছে ইসলাম ধর্মের নামে। আর সে কারণে বঙ্গবন্ধু ধর্মের নামে রাজনীতি নিষেধ করেছিলেন। ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করার জন্য ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করা হয়েছে।
‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে এই ’৭২-এর সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকীকরণের জন্য। এই সংবিধানকে দুই জেনারেল জিয়া ও এরশাদ কলংকিত করেছেন। আমরা আশা করেছিলাম পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে তা যেন আগের মতো হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, আমরা এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে তিনটি দাবি করেছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিরুদ্ধ করতে না পারব ততক্ষণ পর্যন্ত সংখ্যালঘুর অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করতে হবে। পৃথক মন্ত্রণালয় থাকতে হবে এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন থাকতে হবে। কারণ মামলা হলে সাক্ষী পাওয়া যায় না।’
বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, ‘আমেরিকার সংবিধান প্রণেতা থমাস জেফারসন সেক্যুলারিজম প্রচার করেছেন। তবে তার সেক্যুলারিজম আর আমাদের সেক্যুলারিজম আলাদা। সেখানে সেক্যুলারিজম অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে একটা দেয়াল তৈরি করা। কিন্তু আমাদের এখানে তা বলা হয়নি।
‘আমরা বলেছি- রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার। তার মানে তাদের থেকে আমরা ভিন্ন। আমাদের এখানে ধর্ম অর্থ ধারণ করা। এটা আমার শিক্ষক ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আমাকে বলেছিলেন। এই ধারণ করা মানে মানবতা ধারণ করা।’
আবু সাইয়িদ বলেন, ‘সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থেকে তা রেখে দিয়েছে। প্রজাতন্ত্রের ৭ অনুচ্ছেদ, রাষ্ট্র পরিচালনার ২৭ অনুচ্ছেদ, মৌলিক অধিকার ও ৫১টি জায়গায় হাত দেয়া যাবে না। সংশোধন করা যাবে না। কেন করা যাবে না?’
নাট্যকার মামুনুর রশীদ বলেন, আমাদের জনগণ সংবিধান বোঝে না আর বাজেট বোঝে না। আর সংবিধান না বোঝার ফলে তারা কিছুই জানতে পারে না। যখন এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিলেন তখন আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু সেটা বড় আকার নেয়নি।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে সব শাসক গোষ্ঠী পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। আর আমাদের একটা বিষয় পড়ানো হতো- কনস্টিটিউশনাল ডেভেলভমেন্ট অফ পাকিস্তান। সেখানে প্রথম কথাটাই ছিল- পাকিস্তান একটি গবেষণাগার।
‘পাকিস্তানের একটি সংবিধান হয়েছে, ওইটি পরে স্থগিত হয়েছে। আমাদের দেশেও তাই। ৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর তা স্থগিত হয়েছে। আর স্থগিত হওয়া সংবিধানে আবার ঢুকে গেছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিধান।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবু আহসান মো. সামসুল আরেফিন সিদ্দিক বলনে, ‘বঙ্গবন্ধু ৪ নভেম্বর সংসদে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি চারটি খুঁটির কথা বলেছিলেন। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরেপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। এই চারটি খুঁটি তিনি স্থাপন করেছিলেন ও বলেছিলেন।’
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘জেনারেল জিয়াউর রহমান বিসমিল্লাহ লাগিয়েছেন…, আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস ইত্যাদি। আর জিয়াউল হক পাকিস্তানে করলেন আর্টিকেল-২। আর তার দেখাদেখি আরেক জেনারেল এখানে রাষ্ট্রধর্ম করলেন।
‘এখানে বিসমিল্লাহ আছে, আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস আছে, তারপর আছে রাষ্ট্রধর্ম। অনেক সংশোধনী নিয়ে তো বড় বড় বুলি আওড়াচ্ছেন। অমুক করেছে, তমুক করেছে, আমাদের কিছু করার নাই। ওই ব্যাপারে কোনো কথা নেই। উল্টো পঞ্চদশ সংশোধনীতে ওইটা আরও পাকা করে ফেলেছে।
তিনি বলেন, এই সংবিধানে বঙ্গবন্ধু আছেন, জেনারেল জিয়া আছেন, জিয়াউল হক আছেন, এরশাদ আছেন। আবার শেখ হাসিনাও আছেন। কারণ পঞ্চদশ সংশোধনী শেখা হাসিনা করেছেন। ভবিষ্যতে এগুলো নিয়ে আলাপ হবে।’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাণা দাশগুপ্ত বলেন, ‘বাহাত্তরের সংবিধান পাকিস্তানি মোড়কের সংবিধানের অনুরূপে আজও আবর্তিত। রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষানীতি, সমাজনীতি, প্রশাসন সবটাই আজ মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা থেকে অনেক দূরে ছিটকে পড়েছে।
‘বিগত তের বছরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সরকার দেশের অবকাঠামোগত প্রচুর উন্নয়ন করেছে। কিন্তু আপামর বাঙালি জাতি মননে-মানসিকতায় ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের বিকল্প নেই।
রাণা দাশগুপ্ত বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কথায় কথায় বলেন যে সংবিধানে সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্রধর্ম শুধু বাঙালি জাতিসত্তায় বিভাজন টানেনি; ধর্মীয় সংখ্যাগুরু জনগণের ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হওয়ায় এদেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুরা কার্যত রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।’