নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফটোকপি করা হয় বিমান বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. যাহিদ হোসেনের কক্ষে। আর সেখান থেকেই ছবি তুলে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়নে নিরাপত্তা ত্রুটির কারণেই তা ফাঁস হয়েছে, যার দায়ভার এড়াতে পারেন না ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকে এমন অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা বাতিল ও সার্বিক তদন্তে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (লালবাগ) বিভাগ। তদন্তে পাওয়া তথ্য ও গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে ৯জনের দেয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্পষ্ট হয়েছে এমডি যে এমডির কক্ষ থেকেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এই প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে এ পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। এছাড়াও বেশকিছু ব্লাঙ্ক চেক উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিবি পুলিশ বলছে, প্রশ্নফাঁস করেছেন এমডি’র অফিস সহকারী জাহিদ। নিয়োগ পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে একটি কমিটি রয়েছে। তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। এই ঘটনায় যাদের দায় আছে, তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। নিয়োগ পরীক্ষার সদস্যদের কয়েকজনকে ইতোমধ্যে টেলিফোনে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ।
তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে নিয়োগ পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির ঘটনায় ২১ অক্টোবর ডিবি লালবাগ বিমানবন্দর এলাকার কাওলা থেকে আওলাদ হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, এনামুল হক, হারুন-অর-রশিদ ও মাহফুজুল আলম নামে বিমানের পাঁচ কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্রের সফ্ট কপি, টাকা, ব্যাংকের চেক, স্ট্যাম্প, মোবাইল নম্বর, ডায়েরি ও পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র উদ্ধার করা হয়।
এরপর প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমানের আরও পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- মো. মাসুদ, জাহিদ হাসান, সমাজু ওরফে সোবহান, জাবেদ হোসেন ও জাকির হোসেন।
গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে নগদ দেড় লাখ টাকা, বিভিন্ন ব্যাংকের ৩২টি চেক, ১৭টি নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, ১৪টি মোবাইল ফোন সেট, মোটর সাইকেল, তিনটি ডায়েরি, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের হার্ড কপি ও সফ্ট কপি এবং নিয়োগ প্রার্থীদের ৫৪টি প্রবেশপত্র।
ডিবি প্রধান বলেন, গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে ৯জন প্রশ্ন ফাঁসে নিজেদের ও অন্যদের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা প্রশ্ন ফাঁসের পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন।
পরীক্ষা কমিটির প্রধান বিমানের জিএম অ্যাডমিনের কক্ষে প্রশ্নপত্র তৈরি হয়। সেখান থেকে একজন প্রশ্নপত্রের ছবি তোলেন। ২০ অক্টোবর বিমানের লোগো মুছে ফেলে ৮০টি প্রশ্ন টিক চিহ্ন দিয়ে আরও দুজনের কাছে সরবরাহ করা হয়। তা নিয়ে ওই দুজন মোটরসাইকেলযোগে চলে যান।
আবার ১৯ অক্টোবর সামারাইজ প্রশ্নের ফটোকপি করার দায়িত্ব দেয়া হয় এমডির অফিস সহকারী জাহিদ হোসেনকে। তিনি ফটোকপি করার সময় স্মার্ট ফোনে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে সোবহানের কাছে পাঠিয়ে দেন। সোবহান আরও কয়েকজনের কাছে তা সরবরাহ করেন।
বিমান কর্তৃপক্ষ প্রতিটি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র তৈরি, প্রিন্টিং ও পরীক্ষা আয়োজনের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। কিন্তু পুরো বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা এই কমিটি তা সঠিকভাবে পালন করেনি।
গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে বলেছেন, ইতোপূর্বে বিমানে বিভিন্ন নিয়োগের সময়ও তারা একইভাবে প্র্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন।
১৬৪ ধারায় তাদের জবানবন্দি ও যাবতীয় ডিজিটাল তথ্য-উপাত্তে এটা স্পষ্ট যে, তারা অর্থের বিনিময়ে আগেও এমন অপকর্ম করেছেন। ২১ অক্টোবরও বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে নগদ টাকা সংগ্রহ ও প্রশ্নসহ উত্তরপত্র বিতরণ করেছেন তারা।
এক প্রশ্নের জবাবে হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে আরও অনেকের নাম বলেছেন। ১৬৪ ধারায় দেয়া তাদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যও সংগ্রহ করা হয়েছে।
‘সবকিছু মিলে যাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁসের দায় এসেছে, তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে নিয়োগ পরীক্ষার সদস্যদের কাউকে ফোনে আবার কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মামলার তদন্ত ও নিষ্পত্তির স্বার্থে প্রয়োজনে আরও অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এখন পর্যন্ত আমরা বিমানে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ৫০ লাখ টাকা লেনদেনের কংক্রিট তথ্য পেয়েছি। তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১২টি পদে নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ধার্য তারিখ ছিল ২১ অক্টোবর। কিন্তু পরীক্ষার আগে একটি অসাধু চক্র বিমানের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। চক্রটি নিয়োগ প্রত্যাশীদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এই প্রশ্নপত্র বিক্রি করে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় ২৬ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। মামলাটি গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ তদন্ত করছে।