মঙ্গলবার রাতেও মা আদর করে মুখে তুলে খাইয়েছে একমাত্র সন্তান শাওনকে। এরপর সে ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে।
প্রতিদিনের মতো বুধবার ভোরে মা-বাবা ঘুম থেকে উঠিয়ে নাশতা খাইয়ে দিয়েছে শাওনকে। এরপর তাকে বাড়িতে রেখে তারা রওনা হয়েছিল কর্মস্থল পোশাক কারখানায়।
কে জানত পথেই ইসরাফিল-স্বপ্না দম্পতির জীবন কেড়ে নেবে দ্রুতগতির বাস। চাকায় পিষ্ট হয়ে এই যুগল শিকার হলেন মর্মান্তিক দুর্ঘটনার।
মুহূর্তেই ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেল এক যুগের সাজানো সংসার। আর মা-বাবাকে হারিয়ে কেবলই ছলছল চোখের পানিতে চাপা কষ্টে নির্বাক তাদেরই একমাত্র ছেলেশিশু শাওন।
বুধবার সকালে নিজ কর্মস্থল গ্রাফিক্স ডিজাইন কারখানার সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বালিথা এলাকায় বাসচাপায় মৃত্যু হয় ইসরাফিল হোসেন ও স্বপ্না বেগম দম্পতির।
এ সময় মানিকগঞ্জের গোলড়া হাইওয়ে থানার পুলিশ কুষ্টিয়া থেকে ঢাকাগামী দূরপাল্লার জামাল পরিবহনের বাসটি আটক করে। তবে পালিয়ে যান চালক ও সহকারী।
ইসরাফিল-স্বপ্না দম্পতির মৃত্যুর সংবাদ মুহূর্তেই পৌঁছে যায় ধামরাইয়ের সানোড়া ইউনিয়নের শোলধন এলাকায় তাদের বাড়িতে।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ঘরের ছোট্ট এক কক্ষে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে সংসার পেতেছিলেন এই দম্পতি।
আজ সেখানে তাদের স্বজন, প্রতিবেশী ও এলাকার মানুষজনের কান্নার রোল পড়েছে। এত মানুষের আর্তনাদের মাঝে নিহত দম্পতির আট বছর বয়সী ছেলে শাওন ছিল নির্বাক, নিস্তব্ধ।
সে বুঝতে পারছে তার প্রিয় বাবা-মা আর পৃথিবীতে নেই। কিন্তু সবার মতো করে চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না শাওন। ছলছল চোখে অপলক তাকিয়ে আছে ছেলেটি। যেন বাবা-মাকে হারানোর বেদনা নিস্তব্ধ করে দিয়েছে তাকে।
স্বজনেরা জানান, প্রায় ১২ বছর আগে পারিবারিকভাবে ইসরাফিল ও স্বপ্নার বিয়ে হয়।
দুই বছর পরে তাদের একমাত্র সন্তান শাওনের জন্ম। কয়েক বছর ধরে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন ইসরাফিল। কিছুদিন ধরে বাড়িতে নতুন ঘর তোলার চেষ্টা করছিলেন তিনি। কিন্তু একার রোজগারে অর্থের সংকুলান না হওয়ায় স্ত্রী স্বপ্নাকেও কারখানায় চাকরি নিয়ে দেন।
সাইকেলে চেপে প্রতিদিন তারা দুজন কারখানায় যেতেন। কিন্তু আজ সকালে কারখানায় যাওয়ার পথে বাসচাপায় চিরতরে থেমে যায় তাদের জীবনের চাকা।
ইসরাফিল-স্বপ্না দম্পত্তির শিশুসন্তানকে কোলে জড়িয়ে কাঁদছিলেন ফুফু নাজনীন আক্তার। বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার এই ভাতিজার কী হবে? তার তো কেউ রইল না। গতকাল রাতে শাওনরে খাওয়ায় দিছে ওর মা। বাপ-মায়ের সাথেই ঘুমাইছিল সে। আজকে সকালেও শাওনরে খাওয়ায় দিয়ে কাজে গেছিল। ও তো বুঝতেছেও না, কী হারাল ও।’
ইসরাফিলের চাচি মরিয়ম আক্তার বলেন, ‘খুব হাসিখুশি ও মিশুক ছিল ওরা। বউটা চাকরি যেমন করত বাড়ির সব কাজও একাই করত। এক রুমে থাকত দেখে একটা বাড়ি করতে চাইছিল। কিন্তু টাকাপয়সায় কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। এ জন্য দুই মাস আগে কারখানায় চাকরি নেয়। আর আজকে কারখানায় যাওয়ার সময় মারা গেল।’
তিনি বলেন, ‘ছেলেটা এতিম হয়ে গেল। এই ছেলের জন্য ঘরভর্তি জিনিসপত্র করছিল। কিন্তু এসব এখন কে দেখবে, কে খাবে?’