‘মন চালেও পরিবারের সাধ-আল্লাদ মিটাবার পারি না। ২৯ বছর ধরা চৌকিদারের (গ্রাম পুলিশ) চাকরি করিচ্ছি। হামার অভাব-অনটন আর গেল না জীবন থ্যাকা। লজ্জায় কাকো কবার পারি না অভাবের কথা। ঋণ করা চালান লাগে সংসার।’
নিজের জীবনের কষ্টের কথাগুলো জানাচ্ছিলেন নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়ন এর খোর্দচাম্পা গ্রামের গ্রাম পুলিশ এনামুল হক। ৫৫ বছর বয়সী এই মানুষটি প্রায় তিন দশক হাজীনগর ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ হিসেবে কর্মরত আছেন।
১৯৯২ সালে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে আর পড়তে পারেননি। পেশা হিসেবে বেছে নেন গ্রাম পুলিশের চাকরি। কিন্তু এই চাকরিতে বেতন আর সুযোগ-সুবিধা এতটাই কম যে, টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের খোর্দচাম্পা গ্রামের গ্রাম পুলিশ এনামুল হক। ৫৫ বছর বয়সী এই মানুষটি প্রায় তিন দশক হাজীনগর ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ হিসেবে কর্মরত আছেন। ছবি: নিউজবাংলা
এনামুলের জীবনে যুদ্ধ দুটি। একটি হলো এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত, দ্বিতীয়ত অভাবের বিরুদ্ধে।
সারা দেশে ৪৬ হাজার ৮৭০ জন গ্রাম পুলিশ সদস্য আছেন। এর মধ্যে দফাদার ৭ হাজার টাকা ও মহল্লদার সাড়ে ৬ হাজার টাকা বেতন পান।
এই টাকায় সংসার চালানো নিতান্তই কঠিন। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়টি আরও বেশি কষ্ট দিচ্ছে তাদের।
এনামুল একজন মহল্লাদার। তার সঙ্গে কথা বলতে ইউনিয়ন পরিষদে যাওয়ার সময়টা ছিল বিকেল। পরিষদের কাজের চাপ কিছুটা কম। তবে তার কাজের শেষ নেই। কথা বলতে বলতে আবার চলে যেতে হচ্ছিল পরিষদের নানা কাজে হাত লাগাতে।
একপর্যায়ে ইউপি সচিব ও স্থানীয় এক মেম্বারকে বলে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলার ফুরসত মিলল। পরিষদের বারান্দার একপাশে চেয়ারে বসে এনামুল বলছিলেন তার জীবনের কথা।
বললেন, ‘বাবা তোমার জন্য একটু মনে হয় শরীরডা জুড়ানোর সময় পানু।’
কেমন আছেন- প্রশ্নের জবাবটি হলো দীর্ঘ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আসা দেখবার পালিন (এসে দেখতে পেয়েছেন) কেমন আসি। সেই সকাল ৯টার দিকে আসিছি, এখন পর্যন্ত কামের উপরই আছি। সন্ধ্যা বা রাত কখন যে বাড়িত যামু, ছুটি হবে কখন বলা পারিচ্ছি না।’
‘দু বেলা ডাল-ভাত খাইয়া যেন বাঁচবার পারি, সেই আশায় ২৯ বছর আগে এই চাকরিত যোগ দিছনু। একন মনে হয়, কী পানু এতদিন চাকরি করা? যে বেতন পাই সেডা দিয়া আজ থাকা ১৫-২০ বছর আগে কোনো রকমে চলাবার পারুচ্ছুনু আর একন সংসার চালান প্রায় অসম্ভব হইয়া গেছে।
‘তখন জিনিসপত্রসহ সব কিছুর দাম কম আছিল, আর একন সব কিছুর দাম-দর বাড়া গেছে। কিন্তু হামার মতো চৌকিদারের জীবনে পরিবর্তন আসেনি।’
এত হতাশার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিবারত এক ছেলে এক মেয়ে ও হামার স্ত্রীকে লিয়া সংসার। কয়েক বছর আগে হামার মেয়েডাক ধারদেনা করা বিয়া দিছি। এখন এক ছেলে আছে তোমার মতো ২৭-২৮ বছর বয়স হবে। লেকাপড়া তেমন করাবার পারিনি। একন বেকার।
‘হামার যে দেড় বিঘার মতো জমি আছে, সেডাই আবাদ করে। কিন্তু ওইটুকু জমির ধান দিয়া হামার সংসারে খাওয়ার জন্নি চাল লাগে। তাও মাঝে মাঝে চাল শর্ট পড়া যায়, তখন কিনা লাগে। ছোলডাক কোনো কামোত লাগামু বা ব্যবসাত দাড় করা দিমু সেই সামর্থ্যও যে নাই। সব মিলা দুই চোখোত খালি হতাশা দেকিচ্ছি।’
২৯ বছরে বেতন কতটা বাড়ল?
এনামুল বলেন, ‘১৯৯২ সালে ৭০০ টেক্যা দিয়া চাকরি শুরু করি। তারপর ২০০১ সালে বেতন হয় ১৯০০ টেক্যা, ২০০৪ সালে বেতন বাড়া হয় ৩০০০ টেক্যা, ২০১৬ সালে ৬৫০০ টেক্যা এবং বর্তমানে গত দুই বছর থ্যাকা বেতন পাচ্ছি প্রতি মাসে ৬৫০০ টেক্যা করা।’
এই বেতনের অর্ধেক সরকারিভাবে বাকি অর্ধেক দেয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। সরকারি অংশ নিয়মিত পেলেও ইউনিয়ন পরিষদের টাকা নিয়মিত পাওয়াও যায় না।
সংসার চালাতে কখনও সখনও ঠেকে গেলে বা মেয়ের বিয়ের জন্য নেয়া ঋণ এখন লাখ ছাড়িয়েছে। টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন, এ নিয়ে দুশ্চিন্তাও এনামুলকে পীড়া দিচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘হামার পরিবারের ছোল ও বউ এর ভরণপোষণ, হাট বাজার, অসুখবিসুখে খরচ হইয়া যায় মেল্যা টেক্যা। ধারদেনা আর ঋণ করা চলা লাগিচ্ছে। এই কষ্টের কথা কাকে কমু কও?
‘দিন যতই যাচ্ছে হামার কষ্ট বাড়াই চলিচ্ছে। ঋণ বাড়া যাচ্ছে আরও অভাব মনে জাঁকা বসিচ্ছে হামার সংসারোত। ইউনিয়ন থ্যাকা বাড়তি তেমন কোনো সুযোগ- সুবিধা পাই না’- বলেই কেঁদে ফেলেন এনামুল হক।
কাজের পরিধি ব্যাপক
বেতন সীমিত হলেও কাজের কোনো শেষ নেই এনামুলদের। তার ভাষ্য মতে, ‘ইউনিয়ন পরিষদের কত কাম! মেম্বার, চেয়ারম্যান, সচিব- সবার কামেই সাহায্য করা লাগে।
‘বেশির ভাগ রাতবিরাতেও বিভিন্ন জাগাত ডিউটি করা লাগে। চেয়ারম্যান সাহেব বিচার-সালিশে রাতে গেলে সেটিও থাকা লাগে। পুলিশ আসামি ধরবার আলে অনেক সময় থাকা লাগে, কোনো খানে লাশ উদ্ধার করবার সময় সেটিও থাকা লাগে। এলাকায় রাতে কোনো অনুষ্ঠান হলে সেটি ডিউটি করা লাগে। প্রায় দিনই রাতে কোনো না কোনো খানে ডিউটি লাগাই থাকে। আবার দিনের শুরু থাকা সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিষদে ডিউটি।’
ইউনিয়নটিতে চৌকিদার ১০ জন আর গ্রাম ৪০টি। ফলে ছোটাছুটি থাকে নিত্যদিন। ছুটি বা অবসর নেই বললেই চলে।
গ্রাম পুলিশ বাহিনী কর্মচারী ইউনিয়ন নওগাঁ জেলা শাখার আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলায় ৯৪৫ জন গ্রাম পুলিশ রয়েছে। অধিকাংশই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।’
এদের বেতন-ভাতা বা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৯৭৬ সালে পরিপত্র আকারে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ওই আদেশ প্রত্যেক জেলায় প্রেরণ করা হয়। অথচ ওই পরিপত্র আজ অবধি বাস্তবায়ন হয়নি।'