২০১৮ সালের ১ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হাতে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসপমর্পণ করেছিলেন তইবুর রহমান। সুন্দরবনের বনদস্যু ছিলেন তিনি। এখন সে পথ ছাড়লেও বারবার যেতে হচ্ছে কারাগারে, নিয়মিত হাজির হতে হয় আদালতে।
তইবুরের বাড়ি খুলনার পাইকগাছা উপজেলায়। তিনি বলেন, ‘অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়েছি। সেই দিন থেকে আর কখনও খারাপ কাজে যাওয়ার চিন্তাও করিনি। আমাদের আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী, স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী ও র্যাবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের আশ্বস্ত করেছিল, মামলাগুলো দ্রুত তুলে নেবে। তবে আত্মসর্পণ করার পরেও তিনটি মামলায় আমাকে তিন বার কারাগারে যেতে হয়েছে। আমি কারাগারে গেলে পরিবারের সদস্যরা খুবই দুশ্চিন্তায় থাকে। এলাকার মানুষও তখন হেয় করে। পুলিশে নিয়ে গেলে এলাকার মানুষ ভাবে, আমরা আবারও দস্যুতায় জড়িয়েছি। আমরা চাই দ্রুত মামলাগুলো নিস্পত্তি হোক। আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করি।’
তইবুর জানান, তার দলে ৫ জন সদস্য ছিলেন। আত্মসপমর্পণ করার পরে সবাই সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এখন সবাই আয়বর্ধক কাজ করে ভালো আছে। শুধু আটকে মামলার জটে।
তইবুরের মতোই একই সমস্যায় অন্যারাও। মামলা চলার কারণে কয়েকটি সমস্যার কথা তুলছেন তারা। প্রথমত. মাসে কয়েকদিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়। সেসব দিনে কাজ না করলে আয় হয় না। আবার আইনজীবীর পেছনে যাচ্ছে টাকা। দ্বিতীয়ত. মাঝেমধ্যে পুলিশ এলাকায় আসলে সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। মানুষ ভাবে তারা এখনও দস্যু জীবনে রয়ে গেছে। এটি তাদের স্বাভাবিক কর্মজীবনকে ব্যাহত করছে।
আত্মসমর্পণে মধ্যস্থতা করা র্যাব এবং প্রশাসন জানিয়েছে, হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়া অন্য মামলাগুলো তুলে নেয়ার যে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়ন কাজ চলছে। সবার তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। দ্রুত মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
২০১৮ সালের দলের ৮ জন সদস্য নিয়ে আত্মসপমর্পণ করেছিলেন আনোয়ারুল। তিনি একটি দস্যু দলের সর্দার ছিলেন। বাড়ি কয়রা উপজেলায়।
তিনি বলেন, ‘আমার দলের সবাই সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছে। কেউ কেউ দোকান বা গবাদিপশু পেয়েছে। সবাই মোটামুটি ভালো আছে। তবে আর্থিক সহায়তার অনেক টাকা আমরা নষ্ট করে ফেলেছি মামলার জন্য। আদালতে মামলা পরিচালনার জন্য অনেক টাকার দরকার হয়। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পরে আমরা বেশি টাকা আয় করতে পারি না। একাধিক মামলা থাকায় আমরা হিমশিম খাচ্ছি। সরকারের প্রতি আমাদের অনুরোধ মামলাগুলো দ্রুত তুলে নেয়া হোক।’
কয়রা উপজেলার মোস্তফা নামের বলেন, ‘মামলাতে প্রত্যেক মাসে দুই থেকে তিন বার আদালতে হাজিরা দিতে হয়। আর্থিক সংকটের কারণে, অনেক সময়ে আমরা আদালতে যেতে পারি না। তখন জামিন বাতিল হয়। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যায়।’
রব্বানি নামে আত্মসমর্পণ করা আরেকজন বলেন, ‘আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে ভ্যান চালিয়ে রোজগার করছি। বেশ ভালোই কাটছে। তবে একটাই সমস্যাই মামলা নিয়ে। সীমিত আয় দিয়ে আমাদের পক্ষে একাধিক মামলা চালানো সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের অনেকের মামলার রায় দেয়ার সময় হয়ে গেছে। দ্রুত সেই সব মামলা নিস্পত্তি না হলে হয়তো আমাদের কারাগারে যেতে হবে। এই দুশ্চিন্তায় অনেকেই আছেন।’
দাদভাই বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান জাকির হোসেন বলেন, ‘স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পর থেকে যে আর্থিক সহায়তা পেয়েছি, তা দিয়ে একটি নৌকা ও জাল তৈরি করেছিলাম। তা নদীতে ধরে যা আয় হয়, কোনো মতে সংসার চলে যাচ্ছে। তবে রাতে ঘুম হয়না মামলার চিন্তায়। ভাবি কখন বুঝি রায় হবে, আমাকে কারাগারে নিয়ে গেলে ছেলে মেয়েদের কে দেখবে?
‘এমনিতেই আমাদের অনেকে খারাপ নজরে দেখে, আবার কারাগারে গেলে মানুষ ভাববে আমরা আবারও দস্যুতায় জড়িয়েছি।’
সুন্দরবন উপকূলের বনজীবী ও মৎস্যজীবীরা জলদস্যু ও বনদস্যুদের হাতে জিম্মি ছিল। অবৈধভাবে গাছ কাটা, বন্যপ্রাণী হত্যা, অপহরণ, মুক্তিপণ না পেয়ে মানুষ হত্যা, ডাকাতি ও ট্রলার ছিনতাইসহ নানা রকমের অপরাধে জড়িত ছিল তারা।
২০১২ সালে র্যাব মহাপরিচালককে প্রধান সমন্বয়কারী করে সুন্দরবনে জলদস্যু দমনে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে গোড়াপত্তন ঘটে জলদস্যু মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার। ২০১২ সাল থেকে জোরালো অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জলদস্যুরা। ক্রমাগত অভিযানে ফেরারি জীবনের অবসান ঘটিয়ে আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয় তারা।
২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন সদস্য, ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবন’ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই হিসাবে আজ ‘দস্যুমুক্ত সুন্দরবন’র চতুর্থ বর্ষপূর্তি।
প্রতিবছর সরাসরি সুন্দরবন থেকে সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে উপকূলের প্রায় দুই লাখ মানুষ। প্রতিবছর আড়াই থেকে তিন লাখ পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেন। গত চার বছর ধরে সুন্দরবনে কোনো ডাকাতির খবর পাওয়া যায়নি। পর্যটক, মাওয়ালী, বাওয়ালী, বনজীবী ও বন্যপ্রাণী এখন সবাই নিরাপদ। দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের এ সাফল্য ধরে রেখেছে র্যাব।
র্যাব-৬ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত রাখতে র্যাব সব সময় তৎপর রয়েছে। দুবলার চরে র্যাবের একটি ক্যাম্প বানানোর কাজ চলছে। বনে এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
সাবেক বনদস্যুদের মামলার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ ও হত্যা ছাড়া অন্য মামলা থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার জন্য আমরা যাচাইবাছাই করছি। আশা করি সকলে দ্রুত মামলার জট থেকে মুক্তি পাবে।’
খুলনার জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জমান তালুকদার বলেন, ‘যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। হত্যা ও ধর্ষণ ছাড়া অন্য মামলার তথ্যগুলো আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে দিয়েছি। এখন আইনি প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত হয়তো তাদের মামলা প্রত্যাহার হয়ে যাবে।’