আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার সিদ্ধান্ত হয়। সেই থেকে ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ পৃথককরণ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ আলাদা হলেও বাস্তবে এখনও আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। আর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে ২৩ বছর আগের চূড়ান্ত রায়ের ১২ দফা নির্দেশনা সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়িত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন মামলাটির বাদী সাবেক বিচারক মাসদার হোসেন।
দিবসটি উপলক্ষে সোমবার নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় মাসদার হোসেনের। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই মামলার চূড়ান্ত রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা ছিল। তার মধ্যে ৮ দফায় ছিল সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও স্বাধীন বিচার বিভাগ হবে। কিন্তু এখনও নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জজদের বদলি, বেতন, ছুটি, প্রমোশন সব কিছু হয়ে থাকে। এটা এখনও কার্যকর হয়নি।
তিনি বলেন, এ ছাড়া আলাদা পে-কমিশন করার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। একইভাবে বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে লোয়ার জুডিশিয়ারিতে তুলনামূলকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে মেরিট যাচাই করে জজ নিয়োগ হয়। কিন্তু হায়ার জুডিশিয়ারিতে সেটা হয় না। এটা কিন্তু রায়ের সেই নির্দেশনার পরিপন্থি।
তিনি বলেন, ‘কর্মপরিবেশ, লজিস্টিক বাজেট এগুলোও যথাযথভাবে হয় না। সর্বোপরি বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় সাধারণ মানুষ বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে লাখ লাখ মামলা আদালতে ঝুলছে। বিচারকদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়।
মামলার সংখ্যা বেশি থাকায় প্রতিটি মামলার শুনানির তারিখ ছয় মাস পরও পড়ে। এ কারণে বিচার শেষ হতে অনেক দিন লেগে যায়। এভাবে চললে বিচারপ্রার্থীরা বিচার বিভাগের ওপর আস্থা হারাবে। এ জন্য জরুরি ভিত্তিতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন সাবেক এ বিচারক।
পৃথককরণ দিবস ঘোষণার ১৫ বছরেও রায়ের নির্দেশনা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন না করায় সরকারের অবহেলা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার এটাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। জনস্বার্থে এটার অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত।
মাসদার হোসেন বলেন, ‘এখন রাজনীতিবিদ যারা আছেন তাদের মুখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা নাই। এটা নিয়ে তারা সোচ্চারও না।
‘সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র বিচার বিভাগকে পৃথক করবে, কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকার সংবিধানের সেই বাধ্যবাধকতা পালন করেনি। এমনকি কোনো সচেতন মহলও এটা নিয়ে এগোয়নি। শেষমেশ আমরা নিম্ন আদালতের বিচারকরা এগোলাম। তিন-চার যুগ পর রায় হলো, এখন রায়ও যথাযথভাবে কার্যকর হচ্ছে না। এক প্রশ্নের জবাব তিনি বলেন, একেবারেই হচ্ছে না, তা না। বিচার বিভাগ আলাদা হয়েছে, বিচারকাজ বিচারকরাই করছেন। কিন্তু কর্মপরিবেশসহ বিচারকদের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলে এবং নিয়ন্ত্রণমুক্তভাবে বিচার করার স্বাধীনতা না থাকলে, কিভাবে বিচার প্রার্থীরা ন্যায়বিচার পাবেন।
তিনি বলেন, ‘একটা দেশে যদি শক্তিশালী বিচার বিভাগ থাকে, তাহলে দুর্নীতি বন্ধ হয়ে যাবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিচারকরা যদি কঠোর হস্তে দমন করে, তাহলে দেশের দুর্নীতি কমবে, অর্থনীতি প্রবৃদ্ধি হবে, ছিনতাই-রাহাজানি, মাদকমুক্ত হবে সমাজ। এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু এটার অথরিটি যারা, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার সঙ্গে আছেন তাদের সদিচ্ছা থাকতে হবে। এভাবে সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে।
‘বিচার বিভাগ শক্তিশালী হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে, বিচার বিভাগ শক্তিশালী হলে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বহাল থাকবে। মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। সবার আগে এটা ঠিক করা দরকার।’
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পায়নি। সরকার এটাকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। মাসদার হোসেন মামলার আলোকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বারবার তাগিদ দিলেও পরে আর সেটি টিকল না।’
‘পৃথক সচিবালয় থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে বারবার সিনহা সাহেব তাগিদ দিলেও কোনো কাজ হয়নি।’
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ সত্যিকার অর্থে যেভাবে পৃথক হওয়ার দরকার ছিল, সেভাবে তো হয় নাই। নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় যে খসড়া করেছিল। সে সময় আপিল বিভাগ তাতে আপত্তি দিয়েছিল। পরে বিভিন্ন টানাপড়নে সেটি আর হলো না। এরপর যেটা হয়েছে সেটা তো মন্ত্রণালয়ের এক ধরনের কর্তৃত্ব রেখেই করা হয়েছে।
‘পরে অবশ্যই ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিয়ার সময় সেটি অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কাজেই তারা (আইন মন্ত্রণালয়) বলতে পারে এটি সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মাসদার হোসেন মামলার আলোকে যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেটি আসলে হয়নি বলেই আমার মনে হচ্ছে।
বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে এক রিট মামলায় ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দেয়।
রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। ১২ দফা নির্দেশনা হচ্ছে: ১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অফ রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না
২. বিচারিক (জুডিশিয়াল) ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্যান্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন।
৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি।
৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এই কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনো বৈষম্য থাকবে না।
৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।
৬. সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।
৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।
৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।
৯. জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।
১০. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।
১১. এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।
১২. জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।