বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রিপোর্ট আনতেই ডাক্তারের সময় শেষ

  •    
  • ১ নভেম্বর, ২০২২ ১২:৫৮

নদীবেষ্টিত দুর্গম কুড়িগ্রামে সরকারি চিকিৎসা সেবার করুণ হাল। হাসপাতালগুলোয় লোকবল কম। ওষুধ পাওয়া যায় না। সেবার মান খারাপ। দূর-দূরান্তের মানুষ নিয়মিত চিকিৎসা না পেয়ে কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে।

ডান হাত ভেঙ্গে যাওয়ায় জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন কুড়িগ্রাম পৌরসভার মৎস্য খামার এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকিট কেটে ডাক্তার দেখাতে গেলে এক থেকে দুঘণ্টা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এরপর ডাক্তার টেস্ট দিলে সেগুলো করতেই সময় শেষ।

‘রিপোর্ট নিয়ে এসে দেখবেন চেম্বারে ডাক্তার নেই, সময় শেষ, ডাক্তার চলে গেছেন। এখন রিপোর্ট দেখাতে ডাক্তারের ব্যক্তিগত চেম্বারে যেতে হয়। সেখানে ৫-৭শ টাকা ভিজিট দিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। এখন বলেন, কীভাবে আমাদের মতো বেকার বা দরিদ্র মানুষ পাবে সরকারি চিকিৎসা?’

সোহেল রানা পৌরসভার বাসিন্দা। জেলার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের অভিজ্ঞতা হয় আরও করুণ।

দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত হিসেবে পরিচিত কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে এতটাই বঞ্চিত যে অনেকে কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছেন।

এই জেলার ৯টি উপজেলায় প্রায় ২৫ লাখ মানুষের বসবাস, যাদের প্রায় ৭১ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে বলে ২০১৬ সালের এক জরিপে জানিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।

১৬টি নদীবেষ্টিত ৩১৬ কিলোমিটার নৌপথের এ জেলার সাড়ে পাঁচ শতাধিক চরাঞ্চলে বসবাস ৬-৭ লাখ মানুষের। বিপুল এই জনগোষ্ঠির স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সালে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নিত করা হয়। শয্যা বাড়ানো হলেও জনবল সংকটের কারণে দীর্ঘদিনেও চিকিৎসার মান বাড়েনি। চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল না থাকায় উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত সীমান্তঘেঁষা এ জেলার বাসিন্দারা।

চিকিৎসক আর জনবল সংকট দূর না হওয়ায় জেলার চিকিৎসা সেবা মুখ থুবড়ে পড়েছে। দুর্গমতার কারণে অনেক রোগীকে জরুরি সেবার জন্য হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে দরিদ্র মানুষের পক্ষে জেলা-উপজেলা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেয়া প্রায়ই সম্ভব হয় না। সরকারি ওষুধ না পাওয়ারও অভিযোগ হাসপাতালগুলোতে।

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন সকাল-রাতে চিকিৎসকদের রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও সেটি ঠিকভাবে পালন হয় না। সরকারি ছুটির দিন চিকিৎসকের দেখা মেলে না। নামমাত্র ওষুধ পাওয়া যায়, অধিকাংশ ওষুধ কিনতে হয় বাইরে থেকে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট পেতে দেরি হয়ে গেলে চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার গিয়ে ভিজিট দিয়ে রিপোর্ট দেখাতে হয় দূর-দূরান্তের রোগীদের।

পৌর এলাকার বাসিন্দা আশাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মা হাসপাতালে পাঁচ দিন ধরে ভর্তি আছেন। রোগীর কোনো উন্নতি নেই। একটা টেস্ট দিল, সেটা হাসপাতাল থেকে করে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বলল, ভুল হয়েছে, আবার নতুন করে টেস্ট করান। আবারও টেস্ট করিয়ে ডাক্তারকে দেখাব, তিনি নেই। দিনে একবার আসেন ভর্তি হওয়া রোগী দেখতে। টেস্ট করালাম কিন্তু সেদিনের চিকিৎসা পেলাম না। পরে আবার ডাক্তার ভিজিটে এসে চিকিৎসা দেন।

‘ভর্তি রোগীর বড় দুর্ভোগ শুক্রবার বা সরকারি ছুটির দিনে। এদিন হাসপাতালে রোগী দেখতে কোনো ডাক্তার আসেন না। নার্স এবং মেডিক্যাল অ্যাসিসটেন্টরাই চিকিৎসা দেন। জরুরি বিভাগেও একই চিত্র। সেখানে রাতে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায় না।’

সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আবার বাবা ভর্তি করাইছি তিন দিন হলো। এখান থেকে সরকারি ওষুধ দিলেও অধিকাংশ ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। অথচ সরকারিভাবে বিনামূল্যের ওষুধের তালিকা দেয়া আছে। কিন্তু সেখানে কী কী ওষুধের সরবরাহ আছে, সেটা লেখা নেই। তারা কিনে আনতে বলে, আমরা কিনে আনি।’

উলিপুর উপজেলার লায়লা বেগম বলেন, ‘রোগী নিয়ে ১২ দিন যাবৎ আছি হাসপাতালে। এখান থেকেও ওষুধ দেয়। আবার বাইরে থেকেও ওষুধ কিনে আনতে হয়। এভাবেই চিকিৎসা নিচ্ছি হাসপাতালে। রোগীর জন্য যে খাবার দেয়, তা খুবই নিম্নমানের। পাঙ্গাস মাছ এক পিস, একটি কলা, একটি রুটি, ছোট ছোট এক-দু টুকরো ব্রয়লার মুরগির গোশত এবং ভাত দেয়।’

যাত্রাপুর ইউনিয়নের ভগবতি চরের মোখলেস মিয়া বলেন, ‘১০০-১৫০ টাকা নৌকা-অটো ভাড়া দিয়ে হাসপাতালে ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে এক-দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখাতে হয়। ডাক্তার কিছু শোনার আগে ওষুধ লিখে দেয়। সেই ওষুধের কিছু হাসপাতাল থেকে দেয় আর বাইরে থেকেও কিনতে হয়। ঠিকভাবে ডাক্তার না দেখে চিকিৎসা দেয়। এর চেয়ে হামার গ্রামের ডাক্তার ভালো। যে টাকা আর সময় খরচ করি যাই, তা দিয়ে এখানে চিকিৎসা নেই।’

যাত্রাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর বলেন, ‘যাত্রাপুর থেকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে চরাঞ্চল বা প্রত্যন্ত এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষ টাকা ও সময় ব্যয় করে চিকিৎসা নিতে গেলেও সেখানে চিকিৎসা ও ওষুধ না পাওয়ার অভিযোগ আছে। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ ভোগান্তি আর হয়রানি থেকে বাঁচতে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।’

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তৎকালীন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আব্দুস সালাম জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে জানান, ‘দরিদ্রতম এই জেলার মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে দ্রুত চিকিৎসক এবং জনবল নিয়োগ দেয়া হলে কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলবে জেলার সাধারণ মানুষের।’

এ বিভাগের আরো খবর