বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অনলাইনে গেমিং: চিপস বেচে দিনে আয় ৩০ লাখ টাকা

  •    
  • ৩১ অক্টোবর, ২০২২ ১৬:২৩

গেমসের রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে খেলার জন্য কিছু চিপস ফ্রি দেয়া হয়। পরে গেমস খেলার জন্য অর্থের বিনিময়ে চিপস কিনতে হয়। মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে চিপস কেনার টাকা লেনদেন হয়। প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬-৬৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন বট প্লেয়ার বা রোবট প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেইমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের পরে আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হতো। এভাবে করে গেইমারদের হারিয়ে দিত উল্কা গেমসের হয়ে কাজ করা রোবটরূপী ব্যক্তিরা।

দেশে অনলাইন গেমস ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করে উল্কা গেমস প্রাইভেট লিমিটেড। অনলাইন গেমস ডেভেলপ করার কথা বলে ব্যবসায়িক অনুমোদন নিলেও তারা এর আড়ালে শুরু করে অনলাইন জুয়া।

ভারতের কর্ণাটকের গেইমিং প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে কাজ শুরু করে উল্কা গেমস। মুনফ্রগকে দেয়া হয় উল্কা গেমসের ৯৯.৯৯ শতাংশ শেয়ার। বাকি ০.০১ শতাংশ শেয়ার ছিল উল্কা গেমসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও জামিলুর রশিদের কাছে।

জামিলুর রশিদ ও তার সঙ্গীরা দেশের বাজারে 'তিন পাত্তি গোল্ড' নামক অনলাইন জুয়ার অ্যাপটি জনপ্রিয় করে তোলেন।

জামিলুর রশিদ র‌্যাবকে জানান, তিন পাত্তি গোল্ড খেলার জন্য সারা দেশে গেইমার রয়েছে ৯ লাখের বেশি। যাদের কাছে দিনে প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি করা হতো। আর এই চিপস বিক্রির কাজটি করত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের থাকা ১৪ জন লেভেল-১ ডিস্ট্রিবিউটর। তাদেরও সাব-ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে।

বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে চিপস বিক্রির টাকা ডিস্ট্রিবিউটরদের থেকে সংগ্রহ করা হতো।

উল্কা গেমসের সিইও জামিলুর রশিদসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর সোমবার দুপুরে র‌্যাব জানায়, বর্তমানে উল্কা গেমসের ৪টি অ্যাকাউন্টে ৮০ কোটি টাকার বেশি আছে। এ ছাড়া গত দুই বছর তারা মুনফ্রগ ল্যাবকে ব্যাংকের মাধ্যমে ২৯ কোটি টাকা দিয়েছে।

উল্কা গেমসের ৩৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল। বেতন দেয়াসহ অফিস পরিচালনায় প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হতো। এ ছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাৎসরিক বেতনের ৩০ থেকে ৯০ শতাংশ হারে বোনাস দিত প্রতিষ্ঠানটি। উল্কা গেমস প্রায় ২০০ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠিয়েছে।

যেভাবে উল্কা গেমসের যাত্রা

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ২০১৭ সালে ভারতের প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে পরিচয় হয় উল্কা গেমসের সিইও জামিলুর রশিদের। ২০১৮ সালে তিনি মুনফ্রগ ল্যাবের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতনে যুক্ত হন।

মুনফ্রগ ল্যাবের অনলাইন অ্যাপ তিন পাত্তি গোল্ডের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় গেমটিকে আরও বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেন। কয়েকজন আইনজীবীর পরামর্শে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে জামিরুল রশিদ ‘উল্কা গেমস প্রা. লি.’ নামে একটি গেমিং ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেন।

২০১৯ সালে মুনফ্রগের ০.০১ শতাংশ উল্কা গেমসকে দেয়ার মাধ্যমে দেশে গেমিং খাতে উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশে গেইম ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া/ক্যাসিনোর অনুমোদন না থাকায় উল্কা গেমস বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আইনি বৈধতা নেয়ার ব্যবস্থা করে। এভাবেই তিন পাত্তি গোল্ড যাত্রা শুরু করে শহর নগরে ছড়িয়ে পড়ে।

উল্কা গেমসের যাত্রা গেমিং ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও তারা বস্তুত গেম ডেভেলপমেন্ট না করে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাঠাচ্ছিল।

চিপস বিক্রি

তিন পাত্তি গোল্ড মূলত একটি অ্যাপ, যা মোবাইলে ডাউনলোড করে খেলা যায়। এই অ্যাপের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুনফ্রগ ল্যাবের কাছে। অ্যাপে তিন পাত্তি গোল্ড ছাড়াও ‘রাখি’, ‘আন্দর বাহার’ ও ‘পোকার’ নামেও অনলাইন জুয়ার গেমস রয়েছে।

র‌্যাব জানায়, গেমসের রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে খেলার জন্য কিছু চিপস ফ্রি দেয়া হয়। পরে গেমস খেলার জন্য অর্থের বিনিময়ে চিপস কিনতে হয়। মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে চিপস কেনার টাকা লেনদেন হয়।

প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬-৬৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিভিন্ন বট প্লেয়ার বা রোবট প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেইমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের পরে আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হতো। এভাবে করে গেইমারদের হারিয়ে দিত উল্কা গেমসের হয়ে কাজ করা রোবটরূপী ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশে তিন পাত্তি গোল্ডের চিপস বিক্রির কাজটি ১৪টি অফিশিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর বা এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এসব ডিস্ট্রিবিউটরের সাব-ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে।

প্রাইভেট টেবিল অপশনের মাধ্যমে অন্য প্লেয়ার থেকেও চিপস কেনা যায়।

গেইমাদের সঙ্গে প্রতারণা এবং অনলাইন জুয়া পরিচালনার বড় দায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের বলে জানিয়েছে র‌্যাব। বাহিনীটির মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠানটির ইনভলভমেন্ট অনেক বেশি।’

গ্রেপ্তার ছয়জনের পরিচয়

উল্কা গেমসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জামিলুর রশিদ ছাড়াও ধরা পড়েছেন সায়মন হোসেন, রিদোয়ান আহমেদ, রাকিবুল আলম, মুনতাকিম আহমেদ ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ।

জামিলুর রশিদ ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে প্রাচ্যের একটি দেশ থেকে ২০১২ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক পাস করে দেশে ফিরে আসেন। ছোটকাল থেকেই মোবাইল গেমসে আগ্রহী ছিলেন তিনি।

২০১৫ সাল থেকে মোবাইল গেমস তৈরির কাজ শুরু করেন। হিরোজ অব '৭১ ও মুক্তি ক্যাম্প নামে দুটি গেমস তৈরির জন্য ২০১৭ সালে সরকারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা অনুদান পান।

২০১৭ সালে মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। পরের বছর গেমস ডিজাইন কনসালট্যান্ট ও বাংলাদেশে নিযুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে মুনফ্রগ থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতনে যুক্ত হন।

২০১৯ সালে উল্কা গেমস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিইও হিসেবে কাজ শুরু করে মুনফ্রগ থেকে মাসিক প্রায় ৪ লাখ টাকা বেতন পেতেন। এ ছাড়া বাৎসরিক আয়ের ৯০ থেকে ১০০ শতাংশ বোনাস পেতেন।

রিদোয়ান আহমেদ ঢাকার একটি কলেজ থেকে বিবিএ ও এমবিএ করে ২০১৬ সালে পোর্ট ব্লিস নামের একটি গেমিং প্রতিষ্ঠানের অ্যাডমিন অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। তখন জামিলুর রশিদের সঙ্গে তার পরিচয়। ২০১৯ সালে ৪০ হাজার টাকা বেতনে তিনি উল্কা গেমসে যোগ দেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কেনাকাটা, ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট, ইভেন্ট আয়োজনসহ অফিস পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। বর্তমানে তার বেতন এক লাখের বেশি।

কায়েস উদ্দিন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে বিবিএ পাস করে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। ২০২১ সালে তিনি উল্কা গেমসের হেড অব সেলস হিসেবে যোগ দেন। তার নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় ডিস্ট্রিবিউটররা ভার্চ্যুয়াল চিপস বিক্রি, টার্গেট অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করত। তিনি মাসে ২ লাখ টাকার বেশি বেতন পেতেন।

সায়মন হোসেন ঢাকার একটি কলেজ থেকে বিবিএ ও এমবিএ পাস করে ২০২০ সালে উল্কা গেমসে ৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। মুনফ্রগের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক লেনদেনের দায়িত্বও পালন করে আসছিলেন। তার বেতন ছিল প্রায় এক লাখ টাকা।

রাকিবুল আলম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করে ২০১৯ সালে উল্কা গেমসে ‘তিন পাত্তি গোল্ড’-এর চিপস বিক্রির পরিবেশক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি মাঠপর্যায়ে ‘কে অ্যান্ড কে এন্টারপ্রাইজ’-এর নামে গ্রাহকের কাছে ভার্চ্যুয়াল চিপস বিক্রি করতেন। প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা বিক্রি ছিল।

মুনতাকিম আহমেদ বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে প্রাচ্যের একটি দেশ থেকে বিবিএ ও এমবিএ করে দেশে ফিরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ২০১৬ সাল থেকে ট্যাক্স ও ভ্যাটের কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৯ সালে উল্কা গেমসের পরামর্শক হিসেবে যুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কৌশলে কর ফাঁকি দিয়ে ভার্চ্যুয়াল চিপস বিক্রির টাকা দেশের বাইরে পাঠানোর অভিযোগ আছে। উল্কা গেমসে তার তার বেতন দেড় লক্ষাধিক টাকা।

এ বিভাগের আরো খবর