নাটোরের সিংড়া উপজেলার জোড়মল্লিকা গ্রামে পাখি প্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ঝালমুড়ি বিক্রেতা দুলাল হোসেন। প্রতিদিন সকাল-বিকেল খাবার দেয়ার কারণে তিনি হয়ে উঠেছেন পাখিদের আপনজন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জোড়মল্লিকা সেতুর পাশের একটি ঝুপড়ি ঘরে ঝালমুড়ির পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দুলাল হোসেন। কিছুক্ষণ পর তিনি কৌটা থেকে কাগজের ঠোঙ্গায় চানাচুর নিচ্ছেন। ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল ৪টা ছুঁই ছুঁই।
বিদ্যুতের তারে এক এক করে এসে বসতে থাকে শালিখ, বুলবুলি, চড়ুই, বাবুইসহ অন্যান্য পাখি। তখন দুলাল হোসেন চানাচুর নিয়ে বাইরে এসে তারের নিচে গিয়ে চানাচুর মাটিতে ছিটাতে ছিটাতে সজোরে ডাকতে থাকেন, ‘আয়রে আমার তোতা, ময়না। ভয় নাই, আমি আছি, আয়।’
ডাক শুনে নিচে নামতে থাকে পাখিদের ঝাঁক। প্রথম দেখায় মনে হবে যেন পোষ মানানো পাখি। কিন্তু বনের পাখিরা পরম মমতায়, আতিথেয়তায় আপনজন করে নিয়েছে ঝালমুড়ি বিক্রেতা দুলাল হোসেনকে। তাই তার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিদিনই সকাল-বিকেল খাবার খেতে চলে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক পাখি। তাদের দেখাদেখি আসে বুলবুলি, চড়ুই, বাবুইসহ অন্য পাখিরাও।
দুলালের সঙ্গে পাখিদের এই মিতালি বছর পাঁচেক ধরে।
কথা হয় পাখিপ্রেমী দুলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, ‘পাঁচ বছর আগে থেকেই আমি পাখিদের খাবার দেই। প্রথমে একটা-দুইটা করে পাখি আসত। এখন শত শত পাখি আসে। চানাচুর বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করলেও প্রতিদিন এক শ, দুই শ টাকার খাবার দিই পাখিদের।
‘আমার ভিটেমাটি কিছুই নাই। যদি আমার কিনডি বিক্রি করেও পাখিদের খাবার জোগাড় করতে হয়, তবুও আমি তাই করব। আমি সন্তানের মতো পাখিদের দেখাশোনা করি। তারা না খেলে আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করে, অস্থির লাগে।
‘আমি দূরে কোথাও গেলে টাকা দিয়ে লোকজন রেখে যাই, যেন কেউ পাখিদের ক্ষতি করতে না পারে। প্রতিদিন সকাল ৬টা আর বিকেল ৪টার দিকে পাখিরা দল বেঁধে খেতে আসে। এখানের পাখিরা চানাচুর ছাড়া কিছুই খায় না।
‘পাখিদের দিকে কেউ ঢিল ছুড়ে মারলে মনে হয়, আমার শরীরে ঢিল মেরেছে। এই এলাকায় আমি পাখিদের দেখে রাখি। তাদের অনিষ্ট যাতে কেউ করতে না পারে, সেদিকে সব সময় নজর রাখি।’
স্থানীয় বাসিন্দা আবু সাঈদ বলেন, ‘পাখির সঙ্গে দুলাল হোসেনের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাখিরা তাকে অনুসরণ করে। তিনি পাখিদের খাবার দেন, যত্ন নেন। ঝড়ে বাসা ভেঙে গেলে পাখির বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে রেখে তিনি সেবাযত্ন করে সুস্থ করে আকাশে উড়িয়ে দেন। তিনি ডাক দিলেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি চলে আসে।’
স্কুলছাত্রী সুমাইয়া খাতুন জানান, ‘এর আগে কখনও এমন দৃশ্য দেখিনি যে মানুষের ডাকে পাখি চলে আসে। আমাদের খুবই ভালো লাগে। আমাদের স্কুল থেকে বন্ধু-বান্ধবরা পাখি দেখতে আসে। এতে খুবই ভালো লাগে।’
রবিন খান নামের একজন জানান, ‘জোড়মল্লিকা গ্রামটাই দুলাল কাকুর জন্য পরিচিত হয়ে উঠছে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতোই তার কাজকারবার। তার এই মহতী কাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সবারই এগিয়ে আসা উচিত। অভাব-অনটনের মাঝেও মানুষের মাঝে এমন পাখিপ্রেম এখন আর খুব একটা দেখা যায় না।’
চলনবিল পরিবেশ উন্নয়ন ও প্রকৃতি সংরক্ষণ ফোরামের সভাপতি রাজু আহমেদ বলেন, ‘পাখিদের খাওয়ানোর মাঝে আনন্দ পান ঝালমুড়ি বিক্রেতা দুলাল হোসেন। জীবনের নানা পথঘাট পেরিয়ে তার আনন্দ আর উচ্ছ্বাস এই পাখিদের ঘিরে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত থাকলেও দুলাল হোসেনের পাখিপ্রেম বেশ ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা। পাখির সঙ্গে এ অভিনব সখ্যতার খবর এখন এলাকার মানুষের মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে দুলালের এই পাখিপ্রেম দেখতে আসেন অনেকে। মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে বনের পাখিরা ছুটে আসছে- এমন দৃশ্য দেখে যে কারো মনপ্রাণ জুড়িয়ে যাবে।’
জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হয়েও দুলাল হোসেন পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের খাবার দিচ্ছেন। দুলালের এই পাখিপ্রেম জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমি মনে করি, বিত্তশালী যারা আছেন, তারাও পাখির খাবার সংস্থানে দুলাল হোসেনকে সহযোগিতা করতে পারেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাখিদের খাবারের জন্য অর্থ প্রদান করা হবে।’