বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন, রাজনৈতিক দলের দাবি-দাওয়া আর শুভেচ্ছা পোস্টারে ভরে গেছে মেট্রোরেলের পিলার। এমনকি পিলারের গায়ে দেওয়াল লিখনও বাদ যাচ্ছে না। এ কারণে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে এ প্রকল্পের বাহ্যিক চেহারা।
ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগানোর অপরাধে আটক হয়েছেন ১৮ জন। তারপরও থামছে না পোস্টার লাগানো।
কয়েক মাস আগে দেশের প্রবীণ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার ফেসবুকে পোস্টে লিখেছিলেন, ‘কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করে আমরা মেট্রোরেল নির্মাণ করতে পারি, অথচ পিলারগুলোকে পোস্টারমুক্ত রাখার সামান্য উদ্যোগটি আমরা নিতে পারি না।’
মেট্রোরেল প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পিলারে সবচেয়ে বেশি পোস্টার লাগানো হয়েছে মিরপুরের পল্লবী এলাকায়। পল্লবী মেট্রো স্টেশন থেকে মিরপুর ডিওএইচএস-এর আগ পর্যন্ত প্রতিটি পিলারের বিচিত্র পোস্টার সাঁটানো।
মিরপুর-১০ নম্বর থেকে পল্লবী স্টেশন পর্যন্ত এক মাস আগেও অসংখ্য পোস্টার দেখা গেলেও সেগুলো অপসারণ করা হয়েছে। এখন দু-একটি ছাড়া তেমন কোনো পোস্টার চোখে পড়ে না।
স্থানীয়রা জানান, কিছুদিন আগে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এই এলাকার পিলারের পোস্টার উঠিয়ে ফেলেছে। এ ছাড়া এক পিলার পর পর ছোট একটি নির্দেশনাও চোখে পড়ল। সেখানে পোস্টার না লাগানোর নির্দেশনা লেখা আছে।
আগাঁরগাওয়ে এসে দেখা যায়, বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো শুধু পোস্টারই লাগায়নি, তারা পিলারে রং দিয়ে দেওয়াল লিখনও লিখে রেখেছে। এ ছাড়া ফার্মগেট, শাহবাগ পল্টন, মতিঝিলের পিলারগুলো আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম রাজনৈতিক সংগঠন, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন ব্যক্তির প্রচারনামূলক পোস্টারে ভরে গেছে।
এসবের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছেন নগরবাসীরা।
মিরপুর পল্লবী এলাকার তরিকুল ইসলাম নামে এক পথচারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেট্রোরেল নির্মাণের কারণে রাস্তা খোঁড়া-খুঁড়ি আর ধুলাবালির জন্য গত চার-পাঁচ বছর মিরপুরের এই প্রধান সড়কের দিকে তাকানো যেত না। তখন ভাবতাম মেট্রোরেলের কাজ শেষ হলে একদিন এই এলাকা হবে সবচেয়ে দৃষ্টি নন্দন। কিন্তু এখন বুঝছি, আমার ধারণা ভুল। রেলের কাজই শেষ হয়নি, এখনই পিলারে পোস্টার ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। আর কাজ শেষ হলে তো দেখা যাবে শুধু পিলার না স্টেশনের ভিতরেও পোস্টারসন্ত্রাসীরা পোস্টার সাঁটাচ্ছে।’
শাহবাগ এলাকার উজ্জ্বল হাসান নামে আরেকজন পথচারী বলেন, ‘সরকার যদি দক্ষিণ ঢাকার জাতীয় পার্টির নেতা হাজী সাইফুদ্দিন আহম্মেদ মিলন আর উত্তর ঢাকায় আওয়ামী লীগের এমপি ইলিয়াস আলী মোল্লা ও তার পরিবারের সদস্যদের পোস্টার মারা বন্ধ করতে পারে, তাহলে দেখবেন ঢাকা শহরে পোস্টার অনেক কমে গেছে।’
কাজীপাড়া এলাকার রিপন দাস বলেন, ‘দু মাস পরেই আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হবে। এখন থেকেই রাস্তার মাঝে আইল্যান্ড তৈরি করে স্টিলের ব্যারিয়ার দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শুনেছি এই আইল্যান্ডের মাঝে গাছ-গাছালি লাগিয়ে দৃষ্টিনন্দন করা হবে। কিন্তু পিলারে পোস্টার মারা বন্ধ না হলে যতই সুন্দর করে তৈরি করেন না কেন, সেটা দৃষ্টি দূষণই হবে।’
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের কর্তৃপক্ষ এখন ডিএমটিসিএল। রাস্তা সিটি করপোরেশনের হলেও মেট্রোরেলের কর্তৃপক্ষ পিলারকে কেন্দ্র করে রোড ডিভাইডারের কাজ করছে। তাই এখনও এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষই করছে। কাজ শেষ হলে পিলার ও রোড ডিভাইডারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন পেলে তখন এই পোস্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’
গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর মোহম্মাদপুরে নগর পরিবহন উদ্বোধনকালে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘আমরা অনেক বড় প্রকল্প করছি, এই যেমন মেট্রোরেল... অথচ এই মেট্রোরেলের পিলার আজ পোস্টারে ভরে গেছে। যেন পিলারগুলো আজ বিভিন্ন নেতা পোস্টার মারার জন্য তৈরি হয়েছে।’
সে সময় উপস্থিত সেতুমন্ত্রী ওরায়দুল কাদেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন ‘আমি আজ মন্ত্রীর কাছে বলতে চাই, আপনি এই বিষয়গুলো দেখবেন। আর নেতাদের বলতে চাই, আওয়ামী লীগ করার জন্য পোস্টার লাগাতে হয় না। আওয়ামী লীগ মানুষের মনের ভেতরে থাকে। নৌকার কোনো ব্যাক গিয়ার নাই, নৌকার আছে ফ্রন্ট গিয়ার, নৌকা শুধু সামনেই চলবে।’
মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগানোর বিষয়ে এমআরটি লাইন-৬ এর উপ প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী (ডিপিএম) মাহফুজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই পোস্টার মারা আমরা কীভাবে বন্ধ করব বুঝতেছি না। আমরা ১০-১৫ বার পিলার থেকে পোস্টার উঠিয়েছি, আমরা থানায় কেস করেছি, বেশ কয়েক জনকে জেলেও দিয়েছি তারপরও পোস্টার লাগানো থামাতে পারছি না। কেউ কেউ আবার রং দিয়ে পিলারে লেখা শুরু করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রজেক্ট শেষের দিকে হওয়ায় আমাদের নিরাপত্তা কর্মী কমাতে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে এখন আমরা স্টেশনগুলো ছাড়া সকল পিলারের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। এ কারণে যে যার মতো পোস্টার মারছে, আমরা তো প্রতিটা পিলারে ২৪ ঘণ্টা লোক রেখে পোস্টার মারা বন্ধ করতে পারি না।
‘সরকারের এ বিষয়ে আইন আছে, এখন সরকারের এ আইন বাস্তবায়নে কঠিন সিদ্ধান্তে আসতে হবে এবং জনগণকে সচেতন হতে হবে। জনগণকে বুঝতে হবে এটা আমাদের সম্পদ, এটা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। জনগণ না বুঝলে এটা কেউই বন্ধ করতে পারবে না।’