লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহীদুন্নবী জুয়েল হত্যার দুই বছরেও মামলার বিচার শুরু না হওয়ায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
এ হত্যার ঘটনায় হওয়া তিন মামলার বেশিরভাগ আসামি জামিনে মুক্ত থাকায় আক্ষেপ করে সুষ্ঠু বিচার চেয়েছেন শহীদুন্নবীর স্ত্রী জেসমিন আক্তার।
অন্যদিকে প্রকৃত আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন একটি মামলার বাদী, বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রত্যক্ষদর্শী আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত।
২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন শহীদুন্নবী। সেখানে তাক থেকে কোরআন শরিফ নামানোর সময় দুর্ঘটনাবশত পড়ে যায়। আর এতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি কোরআন অবমাননা করেছেন।
স্থানীয় প্রশাসন গিয়ে শহীদুন্নবীকে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যায়। এরপর উন্মত্ত জনতা পিটিয়ে হত্যা করে তার মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে।
ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছে সিআইডি। ছবি: নিউজবাংলা আরও পড়ুন: বছরের নৃশংসতম হত্যাশহীদুন্নবী হত্যার ঘটনায় লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় আলাদা তিনটি মামলা হয়, যেগুলোতে আসামি করা হয় ১১৪ জনকে। এসব মামলায় ১৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের মধ্যে হাইকোর্ট থেকে জামিনে রয়েছেন ১২১ জন।
‘দুই বছরে বিচার পাইলাম না’
রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন জেলার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রন্থাগারিক শহীদুন্নবী জুয়েল। সেখান থেকেই ব্যক্তিগত কাজে বুড়িমারীতে গিয়ে নির্মমতার শিকার হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি সায়েন্সের সাবেক এ ছাত্র।
রংপুরের বাসায় কথা হয় শহীদুন্নবীর স্ত্রী জেসমিন আক্তারের সঙ্গে। তিনি জানান, দুই সন্তানকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা হারিয়ে দিনের অনেকটা সময় বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন স্বামীর ছবির দিকে।
মারধরে নিহত শহীদুন্নবী জুয়েল। ফাইল ছবিহত্যা মামলার বিচার নিয়ে জেসমিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই বছরে আমি তো কোনো বিচার পাইলাম না। আমার স্বামী তো অপরাধী ছিল না। সে তো নিরপরাধ ছিল।
‘সে কাজে গিয়েছিল বুড়িমারীতে। সে একখানে যেতেই পারে। মিথ্যা অপপ্রচার করে আমার স্বামীকে মেরে আবার লাশ পুড়িয়ে ফেলা হলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুই-একজন বাদে সব আসামি জামিনে মুক্ত রয়েছে। তাতে তো কোনো সুষ্ঠু বিচার হলো না। আমার স্বামীকে মেরে তারা অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।
‘আমার স্বামী নিরপরাধ ছিল। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে একজন লোককে পুড়িয়ে ফেলা হলো? স্বামী হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
‘ভাষা নাই কিছু বলার’
বুড়িমারী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান, মামলার বাদী ও শহীদুন্নবী হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত বলেন, ‘আমার ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সবকিছু ভেঙে জুয়েলকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে হত্যার পর পুড়িয়ে ফেলা হলো লাশ। অথচ সব আসামি জামিনে মুক্ত হয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী বলব? ভাষা নাই কিছু বলার।’
পুলিশ ও আইনজীবীর ভাষ্য
মামলার বিষয়ে পাটগ্রাম কোর্টের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) এবং পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জাহিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিনটি মামলারই চার্জশিট (অভিযোগপত্র) আদালতে দাখিল হয়েছে, তবে কয়েকজন আসামি পলাতক থাকায় এখনও বিচার কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।
‘পলাতক আসামিরা জামিনের আবেদন বা গ্রেপ্তার হলে দ্রুত বিচারিক কার্যক্রম শুরু হতো। যতদিন আসামিরা হাজির হচ্ছে না, ততদিন বিচারিক কার্যক্রমও শুরু করা যাচ্ছে না।’
তিনি জানান, জিআর ১৯৯/২০ মামলায় ৮৫ আসামীর মধ্যে জামিনে মুক্ত ৮২ জন। পলাতক আছেন তিনজন। জিআর ২০০/২০ মামলায় ১০১ আসামির মধ্যে ৯৯ জন জামিনে, একজন পলাতক ও একজন জেলহাজতে রয়েছেন। এ ছাড়া জিআর ২০১/২০ মামলায় ৮৫ আসামির মধ্যে জামিনে রয়েছেন ৮৩ জন। এ মামলায় পলাতক রয়েছেন দুজন।
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও জানান, আসামিদের কারও কারও নাম তিনটি মামলাতেই রয়েছে। কেউ কেউ আবার দুটি মামলার আসামি।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আকমল হোসেন আহমেদ বলেন, ‘শহীদুন্নবী জুয়েল হত্যা মামলার আসামিরা পলাতক থাকায় এখনও বিচার কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। কারণ আসামি পলাতক থাকলে প্রথমে আদালতে হাজিরের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সেটিও না হলে সর্বশেষ হুলিয়া আকারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এসব প্রক্রিয়ার কারণে এখনও শুরু করা যায়নি বিচারিক কার্যক্রম।’