কবিরাজি চিকিৎসার নামে প্রতারণার এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গিয়ে র্যাবের হাতে ধরা পড়লেন খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া একজন।
দেড় যুগ আগে এক নারীকে গলা কেটে হত্যা মামলায় প্রাণদণ্ড পাওয়ার পর সেই ব্যক্তি কবিরাজ সেজে আত্মগোপনে ছিলেন।
তার নাম হেমায়েত খান ওরফে জাহিদ। প্রতারণার একাধিক অভিযোগ পেয়ে বুধবার রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
বৃহস্পতিবার দুপুরে কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান বাহিনীটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, হেমায়েত ২০০৫ সালে বাগেরহাটের চাঞ্চল্যকর মনু বেগম হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডের আসামি। ২০০৯ সালের জুনে ওই মামলায় আদালত হেমায়েতকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এরপর থেকে হেমায়েত দেশে ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কবিরাজের ছদ্মবেশে পলাতক জীবন যাপন করে আসছিলেন।
হেমায়েতের আরেক নাম জাহিদ। তিনি পিরোজপুর নাজিরপুরের সামসুল হক খানের ছেলে। ঢাকার মিরপুরে দীর্ঘদিন কবিরাজি পেশার আড়ালে প্রতারণা করে আসছিলেন বলে অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
সেখানে জনরোষে পড়ে মিরপুর ছেড়ে মোহাম্মদপুরের বছিলায় অবস্থান নেন। এখানেও উঠে একই অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়ে রোগীর ছদ্মবেশ নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তার ডেরা থেকে বিভিন্ন ধরনের ১২৯টি আংটি, তিনটি শঙ্খ, আলাদিনের একটি চেরাগ, দুটি ক্রেস্ট, কবিরাজি-সংক্রান্ত বই ১৫টি, পিতলের একটি পাঞ্জা ও কবিরাজি-সংক্রান্ত অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাগেরহাট সদরে মনু বেগম নামের এক নারীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার হয়। ওই হত্যাকাণ্ডে হেমায়েতসহ ৫ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছিল। তদন্ত শেষে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের জুন মাসে আদালত আসামি হেমায়েতকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়। আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেও মনু হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।’
র্যাব পরিচালক জানান, বাগেরহাটের মনু বেগম মাথাব্যথার রোগী ছিলেন। ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে হেমায়েতের সহযোগী সোবহান তাকে হেমায়েতের কাছে নিয়ে আসেন।
মনুর স্বামী ঢাকায় চাকরি করতেন এবং প্রতি মাসে সংসারের খরচ চালানোর জন্য তার কাছে টাকা পাঠাতেন। মনু তার জমানো টাকা দিয়ে কাপড়ের ব্যবসায় নামেন। স্বামীর পাঠানো টাকা আর কাপড়ের ব্যবসার আয়ে তার কাছে লক্ষাধিক টাকা জমে।
হেমায়েত টাকার বিষয়টি জানতে পেরে সেগুলো হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন বলে জানায় র্যাব। এ জন্য ভেষজ উপাদানের মাধ্যমে মনুকে নিয়মিত ঘুমের ওষুধ দেয়া শুরু করেন।
একপর্যায়ে মনুকে বলা হয়, তার যাবতীয় সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকাপয়সা শত্রুপক্ষের জিনের হাতে পড়তে পারে। নিরাপত্তার জন্য তিনি যেন এগুলো হেমায়েতের হাতে তুলে দেন।
সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে হেমায়েত মনুকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে নেন। তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টাও করা হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করেন। পরে মনুর গলাকাটা লাশ বস্তাবন্দি করে বাড়ির সামনের খালের অপর পাশে ধানক্ষেতে ফেলে রাখা হয়।
বাগেরহাট সদর থানায় এই হত্যার পর হেমায়েত বাগেরহাট ছেড়ে প্রথমে যশোরের একটি মাজারে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে চলে যান ভারতের আজমীরে। সেখানে ৩ বছর অবস্থান করে ২০০৮ সালে ফেরেন দেশে।
দেশে ফিরে প্রথমে ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করেন। পরিচয় গোপন করে লম্বা চুল ও দাড়িওয়ালা ছবি ব্যবহার করে তার আসল নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে জাহিদুল ইসলাম নামে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন।
মিরপুরে থাকাকালে ভাগ্য পরিবর্তন, স্বামী-স্ত্রীর কলহ দূর করা, মানুষ বশীকরণসহ নানা কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে স্থানীয়রা চাপ দিলে মিরপুর ছেড়ে তিনি কিছুদিন আদাবর, কিছুদিন কেরানীগঞ্জ এবং পরে ৫ বছর ধরে মোহাম্মদপুরের বছিলায় বসবাস শুরু করেন।
বছিলাতেও তাবিজ, জিনের বাদশার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলে টাকা নিয়ে আসছিলেন তিনি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে র্যাব।